ভোট সুষ্ঠু করতে কাজ করব : গণমাধ্যমকে নতুন রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর মো. সাহাবুদ্দিন আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে দেশের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখে যেতে চাই। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার স্বার্থে আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। সেখানে যদি ক্ষমতাসীন দল ভিকটিমাইজ হয়, হতে পারে।’
সোমবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচনকর্তা সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল মো. সাহাবুদ্দিনকে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার পর তিনি কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কাছে এসব কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আপনারা আসেন, একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আপনারা পরামর্শ দেবেন। সেই পরামর্শের কথা নির্বাচন কমিশনের কাছে বলবেন। জনগণের রায় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হওয়ার পথে যাতে কোনো রকম অন্তরায় না থাকে। নির্বাচন নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘যদি বিরোধী দল হয়, হতে পারে। কিন্তু আমি চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সেখানে আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। আমি ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সামনে সাংবাদিকদের মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘দেশের মালিক জনগণ। তাহলে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে। ভোট দিতে হবে। নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের মতো করে সরকার গঠন করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, আমার সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা, যেহেতু আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমার আকাঙ্ক্ষা জনগণ যাকেই নির্বাচিত করুক তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের হয়। সরকার ও বিরোধী সব দলকে আহবান জানাব, আপনারা আসেন, একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আপনারা পরামর্শ দেবেন। সেই পরামর্শের কথা নির্বাচন কমিশনের কাছে বলবেন। জনগণের রায় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হওয়ার পথে যাতে কোনো রকম অন্তরায় না থাকে, কোনো রকম প্রশ্ন না হয় সেভাবেই যেন নির্বাচনটি হয়। আমি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখে যেতে চাই।’
পরে যমুনা টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার অনুভূতি : সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার অনুভূতি সম্পর্কে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি এবং আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির যিনি প্রধান সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, দেশরত্ন শেখ হাসিনা, যিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি যেহেতু আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলাম এবং সেই সঙ্গে প্রচার ও প্রকাশনা কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলাম, দলীয় অফিসে মাঝেমধ্যে যাওয়া-আসা হতো। অনেক আলোচনা শুনতাম, কিন্তু আমি কখনো আঁচ করতে পারি নাই যে আমি বিষয়বস্তু হতে পারি। এতটুকু ভাবনা আমার মধ্যে ছিল না। তবে আমি দীর্ঘদিন পেশাগত জীবনের আগে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলাম, এটা সত্য। এটা কিন্তু লুকানো যাবে না। কারণ আমি জেলা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলাম।’
বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ : মো. সাহাবুদ্দিন স্বাধীনতার আগে ছাত্রলীগ করেছেন। উনসত্তরে ১১ দফা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, পাবনায় ভুট্টা আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করেন এবং বলেন, ‘সব কথা বলা হয়, কিন্তু পাবনার ভুট্টা আন্দোলনের কথা ভুলে যায়। সে সময়ে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম ছয় দফা নিয়ে, ১১ দফা নিয়ে মাঠে-ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকারের সংগ্রাম অথবা বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছি। শুধু চেষ্টা নয়, সে সময় লেখাপড়াও করেছি, পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনও করেছি।’
প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের : মো. সাহাবুদ্দিন বাকশাল সম্পর্কে নিজের ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে বলেন, “সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’—এটা বলতেও অনেকে লজ্জাবোধ করেন। এই যে স্বীকৃত যে বিষয়গুলো আছে, সে বিষয়গুলোতে যদি কারো অনীহা থাকে, তবে জাতীয় ঐক্য তো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের।”
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসতে যাচ্ছি, এ সময় হয়তো এই কথা বলা আমার উচিত হবে না। কিন্তু আমি তো আমার বিবেকের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারি না। আমার মুখে এই সত্য ঘটনা পরিষ্কার করে বলতে কোনো আপত্তি নেই। আমি যেটা বিশ্বাস করি, সেটা আমি বলবই। তাদের পুরস্কৃত করা, বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া—এগুলো কখনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’
২০০১ সালে নির্বাচন : তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী যে সহিংসতা হয়েছিল সেই সহিংসতাও কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বিরাট উদাহরণ হয়ে আছে, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ও প্রগতিবাদী নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়, শারীরিক নির্যাতন করা হয়, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, গাছপালা লুণ্ঠন করা হয়, পুকুরের মাছ চুরি করা হয়, ডাকাতি করে মায়ের সামনে মেয়েকে নির্যাতন এবং মেয়ের সামনে শাশুড়িকে নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। আমি এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি এটার একটা রিপোর্ট দেখেছি। আমার শরীর শিউরে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকন্যা কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ের পরে এটার প্রতিশোধ নিতে পারতেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে সারা বাংলাদেশে তখন আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। আওয়ামী লীগ কিন্তু কোনো মিছিল কিংবা মিটিং করেনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন, না, কোনো রকম বিজয় মিছিল করা যাবে না। আর হাতিয়ার হাতে তুলে নেওয়া তো দূরের কথা।’
রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে উদ্যোগ নেবেন : রাষ্ট্রপতি হিসেবে কী উদ্যোগ নেবেন—এই প্রশ্নে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘এই যে মানসিকতার অধঃপতন, সেই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তো আমার প্রশ্ন হলো, আমি অতীতে রাজনীতি করেছি। একটা আদর্শে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী। এখন বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে যেহেতু একটা মহান দায়িত্বে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তর দল আওয়ামী লীগ আমার ওপরে যে দায়িত্ব অর্পণ করল, এই দায়িত্বটা পালন করতে গিয়ে আমার প্রথম কাজ হলো জাতীয় বিভেদকে ঐক্যে রূপান্তর করা। আমি আগেও বলেছি, আমার কোনো ঐশ্বরিক শক্তি নেই যে আমি এটা পারব, তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্যোগ : স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্যাগ সম্পর্কে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হোক, এটা তো শুধু সরকারের কামনা নয়, এটা সারা বিশ্বের কামনা। দেশের সব জনগণের কামনা যে সব দলের অংশগ্রহণে, যতই ছোট দল বা বড় দল বা জোট হোক, সবাইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে তাদের নিজেদের স্বার্থেই আসতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় দুর্যোগ যদি দেখা যায় বা নির্বাচন নিয়ে কোনো অরাজকতা যদি দেখা যায় অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনী পরিবেশটাকে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়, রাষ্ট্রপতির কিছু কিছু কাজ করার থাকে। আমি এ ব্যাপারে পিছপা হব না। কারণ আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমি দেশ স্বাধীন করেছি। এতটুকু রক্ত দিয়েছি দেশের জন্য। তাই নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করা যদি হয়, নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য আমার যে ভূমিকা তা আমি রাখব। কিন্তু আমি চাইব, একটা ন্যায়ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে আমার ক্ষমতাটা যেন প্রয়োগ করি, যাতে সেখানে পক্ষপাতিত্বের কোনো চিহ্নও না থাকে। মানুষ উপলব্ধি করতে পারে যে রাষ্ট্রপতি যে কাজটি করেছে তা দেশের জন্য করেছে।’
ইসলামী ব্যাংক থেকে পদত্যাগ : ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন আইবিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।
চট্টগ্রামের জেএমসি বিল্ডার্সের পক্ষে ২০১৭ সালের জুনে মো. সাহাবুদ্দিন ব্যাংকটির পরিচালক নিযুক্ত হন এবং এরপর তিনি ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। এত দিন একই পদে বহাল ছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রার্থী হওয়ার পরপরই তিনি ব্যাংকটি থেকে পদত্যাগ করেন।
সোমবার সকাল থেকেই গুলশান-১-এর ১২৩ নম্বর সড়কে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত মো. সাহাবুদ্দিনের বাসভবনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিড় দেখা যায়। বিশেষ করে পাবনা থেকে অনেক মানুষ এসে ভিড় করে। দুপুর ১২টার আগে একবার বাসার নিচে নামেন সাহাবুদ্দিন। তিনি আগতদের ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন। দুপুর দেড়টার দিকে সাহাবুদ্দিন বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
তাঁর বাসভবনের সামনে সকাল থেকেই নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত দেখা যায়। সকাল থেকে ১২৩ নম্বর রোডে যানবাহন ও মানুষ চলাচল সীমিত করে দেয় পুলিশ।