ইচ্ছাকৃত ক্ষতির দাবির ব্যাপারে বীমা কোম্পানিগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি করে বীমার অর্থের দাবিদারদের ব্যাপারে বীমা কোম্পানিগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । যথাযথ তদন্ত না করে যে কোনো স্থানের বা প্রভাবশালীদের চাপের মুখে অগ্নিকান্ডে কোনো সম্পত্তির ক্ষতির জন্য বীমার অর্থ ছাড় না করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেন তিনি।
আজ বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় বীমা দিবস-২০২৩-এর উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারো চাপের কাছে আপনারা মাথা নত করবেন না, দয়া করে। আমিই বলেন বা আমাদের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের কাছে নানা ধরনের লোক আসে, তদবিরও করতে পারে সেক্ষেত্রেও আপনাদের দেখতে হবে প্রকৃত ক্ষতি কতটুকু। দাবিদার দাবি করবে বড় একটা কিন্তু তার প্রকৃত ক্ষতি যাচাই-বাছাই করেই আপনারা অর্থ পরিশোধ করবেন।’
‘
তিনি বলেন, ‘সেটা কেন করা হয় না, তাহলে কি আমি মনে করবো যারা তদন্ত করতে আসে তারাও এর ভাগীদার। তাদেরও কোন হাত আছে কি-না সেটাও তো আমার সন্দেহ হচ্ছে। সেটা আপনাদের দেখতে হবে।’
বীমার অর্থ দাবির ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে স্বার্থান্বেষী মহলের অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়েও বীমা কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন আজকে এ কথা বলবেন, কারণ, তিনি যেহেতু এই পরিবারেরই একজন সদস্য (জাতির পিতাও বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেছিলেন) তাই এর বদনাম হোক তা তিনি চান না।
এক সময় তৈরি পোষাক কারখানাগুলোতে ঘন ঘন অগ্নিকান্ড ঘটার প্রসঙ্গ টেনে তদন্ত করে তিনি বীমার মোটা অংকের মিথ্যা অর্থ দাবির প্রমাণ পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন। নাম উল্লেখ না করে কোন একটি কোম্পানির এক নারী কর্মীকে দিয়ে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে অগ্নিকান্ড ঘটানো হয় বলেও তদন্তে বেরিয়েছে বলে জানান তিনি।
সরকার প্রধান বলেন, ‘ঘন ঘন একটা জায়গায় আগুন লাগবে কেন? ইন্সুরেন্সের দাবিদার হয়ে যায়, টাকা পায়। সেক্ষেত্রে আমার অনুরোধ থাকবে বিভিন্ন ইন্সুরেন্স কোম্পানি এবং কর্তৃপক্ষ করে দিয়েছি তাদের এ ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকা দরকার। কতটুকু ক্ষতি হলো তার যথাযথভাবে তদন্ত হওয়া দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যথাযথভাবে তদন্ত না করে কারো চাপে পড়ে কোন টাকা দিবেন না।’
তিনি উদাহারণ দিয়ে বলেন, একটি ফ্ল্যাটে আগুন লাগার ক্ষেত্রে ৪০ কোটি টাকার বীমা দাবিরও তথ্য-প্রমাণ আমার কাছে আছে। একটি ফ্লাটে ৪০ কোটি টাকার কী সম্পদ থাকতে পারে, সে প্রশ্নও তোলেন এবং এর তদন্ত করাবেন বলেও জানান শেখ হাসিনা।
‘কত সম্পদ একটা ফ্ল্যাটের মালিকের কাছে আছে যে তার ৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হলো আর বীমা থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেল। অন্যদিকে যার ঘর সবচেয়ে বেশি পুড়লো তার বীমাও নাই, সে কিছুই পেল না। এসব বিষয়ে সকলকে একটু নজর দিতে হবে’, বলেন তিনি।
অর্থমন্ত্রণালয় এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) যৌথভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান জয়নুল বারী এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বীমা খাতের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
১৯৬০ সালের ১ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। তাই সরকার প্রতিবছর ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং গত বছর একে ‘ক’ ক্যাটাগরি ভুক্ত দিবস হিসেবে উন্নীত করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সকল রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সেই সময় জাতির পিতা ১৯৬০ সালের ১ মার্চ যোগ দেন আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানির বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রধান হিসেবে। জনমুখী এ পেশাটিকে তিনি শুধু চাকুরি নয়, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গেও বীমা কোম্পানির যোগসূত্র রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে বসেই ৬ দফা প্রণয়ন করেছিলেন এবং তাঁদের চড়াই উৎরাইভরা জীবনে এবং ’৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর পুণরায় গ্রেফতারের আগে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকরিকালীন প্রায় দুই বছর সময় তাঁরাও একটু স্থিতিশীল হতে পেরেছিলেন।
‘কাজেই ইন্সুরেন্স কোম্পানির সাথে আমাদের আত্মার একটা যোগাযোগ আছে, এতে কোন সন্দেহ নাই,’ বলেন তিনি।
সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওপর আইয়ুব খানের সরকার বিধিনিষেধ থাকায় তিনি চাইলেই যেকোনো জায়গায় যেতে পারতেন না। কিন্তু ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে বঙ্গবন্ধু জেলায় জেলায় যেতেন। এর মাধ্যমে তিনি মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে মানুষকে সংগঠিত করেন এবং স্বাধীনতার চেতনাকে ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে জাগরুক করারও একটা সুযোগ পান।
ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রণয়ন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বসেই ছয় দফা প্রণয়ন করেছিলেন। পুরো বিষয়টা টাইপ করেছিলেন মোহাম্মদ হানিফ (ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র)। পরে এটা একজন বিজ্ঞজন, তৎকালিন ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালালু্িদ্দন সাহেবকে দিয়ে অনুবাদ করানো হয়। আমাদের যে স্বাধীনতা অর্জন বা ছয় দফা প্রণয়ন, ছয় দফার ভিত্তিতে ৭০ এর নির্বাচন-সবই কিন্তু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বসেই করা হয়। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সের একটা যোগসূত্র রয়ে গেছে, এটাই বাস্তবতা।’
প্রধানমন্ত্রী বীমা ব্যবস্থার উন্নয়নে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে বীমা ব্যবস্থার উন্নয়নে ‘বীমা আইন-২০১০’ এবং ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন-২০১০’ প্রণয়ন করে। এর আওতায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। সরকার ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন অ্যাক্ট-১৯৭৩ রহিত করে বীমা কর্পোরেশন আইন-২০১৯ এবং জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪ প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি বীমা খাতে ‘একচুয়ারি’ নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে।
তিনি বলেন, দেশের বীমা কোম্পানি এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই আমি মনে করি যত বড় বড় মেগা প্রকল্প আমাদের তৈরি হচ্ছে এর সবক্ষেত্রেই বীমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য বীমা, জীবন বীমা এবং বঙ্গবন্ধুর নামে বীমাসহ বহুমুখি বীমার উদ্যোগ নেয়ায় তিনি সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে এর প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এটার খুব দরকার, আপনারা প্রচার-প্রচারণা ভালভাবে করেন। কারণ, আমাদের দেশের মানুষের একটা অনীহা আছে। আর গাড়ির বেলায় থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্স যে কতটা ক্ষতিকর ছিল আমি নিজেও তার ভূক্তভোগী।
তাঁর সরকার বাদ দেয়ার পরও সেটা চালু থাকে কীভাবে এটাও দেখবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এটার ব্যাপারে দেখবো যেন যথাযথ বীমা ছাড়া এই সড়কে কোন ধরনের পরিবহন যেন না চলে। সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রবাসী কর্মী বীমা’, ‘শস্যবীমা’, ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা, খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘বঙ্গবন্ধু স্পোর্টস ম্যান’স কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্স,’ ‘বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা’। এছাড়া, কৃষি, স্বাস্থ্য, ভবন, মোটরযান ও রেলযাত্রীদের জন্য বীমা চালু হয়েছে যেগুলো মানুষকে সুরক্ষা দিবে। কিন্তু এগুলো মানুষ করলো কি-না সেটাও দেখতে হবে।
সরকার বীমা খাত আধুনিকায়নে ‘বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর মাধ্যমে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন, জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স একাডেমির সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
শেখ হাসিনা বলেন, বীমা খাতকে ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনতে ‘ইউনিফাইড মেসেজিং প্লাটফর্ম (ইউএমপি)’ চালু করা হয়েছে। প্লাটফর্মটিতে বর্তমানে সেন্ট্রাল পলিসি রিপোজিটরি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ এসএমএস ও ই-মেইল এলার্ট সেবা, ই-রিসিপ্ট, ই-কেওয়াইসি, ‘বীমা তথ্য’ মোবাইল অ্যাপ, এজেন্ট লাইসেন্সিং অনলাইন মডিউলসহ নানা ডিজিটাল সেবা চলমান রয়েছে। মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে গ্রাহকগণ সুবিধামতো প্রিমিয়াম জমার তথ্য দেখতে পারছেন ও রিসিট সংগ্রহ করতে পারছেন। এতে বীমা কোম্পানিগুলোর কুরিয়ার খরচ কমেছে। সরকারি তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয়ভাবে ই-কেওয়াইসি চালু হওয়ায় জালিয়াতি বন্ধ হয়েছে। এরফলে প্রতিটি বীমা প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। বীমা শিল্পের প্রতি গ্রাহক আস্থা আরও বৃদ্ধিতে ‘ইউএমপি’ আরও বেগবান করতে আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বেকার যুবকদের বীমা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করতেও তিনি সংশ্লিষ্টদের আহবান জানান।
তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতেও পুরস্কার তুলে দেন। পুরস্কার হিসেবে ছিল-একটি ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট এবং জাতির পিতার রচিত তিনটি বই (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীন’)।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে লাইফ ইন্স্যুরেন্স ক্যাটাগরিতে এবং নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স ক্যাটাগরিতে গ্রিন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং সোনার বাংলা লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে সম্মাননা প্রদান করেন।