যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন : বিচারবহির্ভূত হত্যা কমেছে, মানবাধিকার পরিস্থিতর সমালোচনা
২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা নাটকীয়ভাবে কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২২ সালের মানবাধিকার চর্চাবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সোমবার প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে শুরুতেই ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন সোমবার রাতে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বাংলাদেশে ১৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যা বা নিরাপত্তা হেফাজতে হত্যার শিকার হয়েছে। অন্য একটি সংগঠন এ সংখ্যা ২৫ বলে উল্লেখ করেছে। তাদের মধ্যে ১০ জন গুলিতে এবং আরো ১০ জন নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহীন মিয়া নামের একজন গত নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এপ্রিলে কুমিল্লায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মোহাম্মদ রাজু নামের একজন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে গণমাধ্যম। এর কিছুদিন পর মানিকগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কায়সার আহমেদ নামের আরেকজনের মৃত্যুকে যুক্তরাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবে তুলে ধরেছে।
মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে কক্সবাজারে একটি পুলিশ চেকপোস্টে মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে (অব.) গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বাড়াবাড়ির অভিযোগ নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। সিনহা হত্যার রায় ছিল ক্রসফায়ারের অভিযোগে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার প্রথম রায়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নির্যাতন-নিপীড়নে নিরাপত্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। দুর্নীতিকে এখনো এ দেশের বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন মামলার উদাহরণ রয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞরা তাঁর দণ্ডিত হওয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রমাণের ঘাটতি থাকার কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন, ওই বিচার ও সাজা ছিল নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার রাজনৈতিক ছক।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা গত বছর নিষ্পত্তি হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা, বাস পোড়ানো ও বোমাবাজির অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে একটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে বেশির ভাগ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও তাঁর আওয়ামী লীগ দল টানা তৃতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য জয়লাভ করে। ব্যালট বাক্সভর্তি এবং বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ অনিয়মের কারণে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হয়নি।
প্রতিবেদনে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সরকারের উদ্যোগে নির্যাতন-নিষ্ঠুরতা, রাজনৈতিক কারণে বন্দি, ইন্টারনেটে ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধার বেশ কিছু তথ্য তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির ব্যাপক দায়মুক্তির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বা দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের চিহ্নিত, তদন্ত, বিচার এবং শাস্তির জন্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, গত বছর রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে কয়েক হাজার বিএনপিকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা দাবি করেছেন, অনেক মামলাই রাজনেতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ও আওয়ামী লীগের সমালোচক হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমগুলো হয়রানির শিকার হয়েছে। ওই গণমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপন কাটছাঁট করা হয়েছে। এ কারণে অনেক গণমাধ্যম স্বেচ্ছায় সরকারের সমালোচনা এড়িয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতায় রয়েছে গুরুতর বিধিনিষেধ। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং জমায়েতের স্বাধীনতায় ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়। সংগঠনের ওপর, তহবিল অথবা বেসরকারি সংগঠন ও নাগরিক সমাজের সংগঠনের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মারাত্মক ও অযৌক্তিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এছাড়া রয়েছে সরকারের ভয়াবহ দুর্নীতি। অভ্যন্তরীণ অথবা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনের বিরুদ্ধে সরকার মারাত্মকভাবে বিধিনিষেধ দিয়েছে যা হয়রানিমূলক।
ঘাটতি দেখা গেছে লিঙ্গগত সহিংসতার জবাবদিহিতায়।
এতে আরও বলা হয়, স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের অধিকারের জন্য মুক্তভাবে সমাবেশ করা এবং সম্মিলিতভাবে দর কষাকষি করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের নিয়ম লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি দেয়ার বহু বিষয় রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা বা নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন বা দুর্নীতিতে যুক্ত হয়েছেন তাদেরকে শনাক্ত করা, তদন্ত করা, বিচারের আওতায় আনা এবং শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার খুব কমই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় রিপোর্টে।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন নির্যাতন-হয়রানিতে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার অভিযোগ সত্ত্বেও বিচার না পাওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।