তাইওয়ান নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনকে যে বার্তা দিলো চীন
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চীন সফর করছেন রোববার থেকে। আশা করা হচ্ছে যে, এ সফর বিশ্বের এই দুই শক্তিধর দেশের মধ্যে বরফ গলাতে সহায়তা করবে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চীন সফরে যাওয়ার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ব্লিঙ্কেনের। কিন্তু সেসময় যুক্তরাষ্ট্র চীনের সন্দেহভাজন একটি গুপ্তচর বেলুন ভূপাতিত করার পর সেটি পিছিয়ে দেয়া হয়।
গত পাঁচ বছরে এটাই কোন মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিকের প্রথম চীন সফর। এরই মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইয়ের সাথে বৈঠক শেষ করেছেন।
অন্যান্য আরো নানা ইস্যু থাকলেও সম্প্রতি মার্কিন-চীন সম্পর্ক খারাপ হয়েছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্বন্দ্ব, মানবাধিকার এবং তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে উত্তেজনার কারণে।
তাইওয়ান নিয়ে সমঝোতার সুযোগ নেই: ওয়াং
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইয়ের সাথে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বৈঠক নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা বেশি স্থায়ী হয়।
চীনের শীর্ষ কুটনীতিক ওয়াং ই বলেছেন, চীন-আমেরিকার বর্তমান সম্পর্কের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে তার দেশ নিয়ে যুক্তারষ্ট্রের ‘ভূল ধারণা’।
বৈঠকের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ওয়াং ই মি. ব্লিঙ্কেনকে বলেছেন, “তাইওয়ান নিয়ে ‘সমঝোতার কোন সুযোগ নেই’।”
তিনি আরো দাবি করেছেন যে, আমেরিকা যাতে চীনের উপর থেকে একতরফা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
সেই সাথে আমেরিকা যাতে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ওপর ‘দমন চেষ্টা’ বন্ধ করে এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে, সে আহ্বান জানান মি. ই।
তিনি বলেন, ‘সংলাপ বা দ্বন্দ্ব’ এবং ‘সহযোগিতা ও সংঘর্ষে’র মধ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোন একটি বেছে নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতা হতে হবে: ব্লিঙ্কেন
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ব্লিঙ্কেন বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের অবাধ চ্যানেলের চালুর মাধ্যমে ‘দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতা বজায়’ রাখার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যাতে প্রতিযোগিতা দ্বন্দ্বে পরিণত না হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মি. ব্লিঙ্কেন জোর দিয়ে বলেছেন যে, আমেরিকার স্বার্থ এবং মূল্যবোধের পক্ষে তিনি কূটনীতি চালিয়ে যাবেন।
এছাড়া যৌথ উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা করেছেন তারা।
বৈঠককে ‘খোলামেলা ও ফলপ্রসূ’ ছিল উল্লেখ করে মিলার বলেন, দুই কূটনীতিকই দ্বিপক্ষীয় এবং বৈশ্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আমেরিকা-চীন দ্বন্দ্বে তাইওয়ান মূখ্য কেন?
ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে তাইওয়ান ইস্যু।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং রোববার বলেন, এই দ্বীপটি চীনের ‘মূল স্বার্থ সংশ্লিষ্ট’ এবং মার্কিন-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু’।
চীন গণতান্ত্রিক স্বায়ত্ব-শাসিত তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ মনে করে এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিতে শক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয় না।
আর এখন যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সমর্থন দিচ্ছে, তখন চীন একে তাদের দীর্ঘদিনের ‘এক চীন নীতি’র বিরোধী হিসেবে দেখছে।
এই নীতিটি হচ্ছে চীনের অবস্থানকে কূটনীতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া যে, চীনের সরকার শুধুমাত্র একটি-আর সেটি বেইজিংয়ে অবস্থিত। এ নীতির আওতায়, চীন তাইওয়ান ইস্যুতে অন্য দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বা সম্পর্ক রাখা একেবারেই সমর্থন করে না।
চীন আরো চায় আমেরিকা তাইওয়ানের পরিবর্তে সরাসরি বেইজিংয়ের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনীতিক সম্পর্ক বজায় রাখে, এবং তাইওয়ানকে চীনের একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রদেশ হিসেবে দেখে – যা একদিন চীনের সাথে একীভূত হবে বলে চীন বিশ্বাস করে।
এদিকে, মার্কিন নীতি বেইজিংয়ের ওই অবস্থানকে সমর্থন করে না এবং এর আওতায় ওয়াশিংটন তাইওয়ানের সাথে একটি ‘শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক’ সম্পর্ক বজার রাখে।
এর মধ্যে রয়েছে দ্বীপটির কাছে অস্ত্র বিক্রি যাতে তারা নিজের প্রতিরক্ষায় সেসব ব্যবহার করতে পারে।
তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘প্রথম দ্বীপ শৃঙ্খল’ বা ‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’ এর তালিকাভূক্ত দেশ, যাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চীন আমেরিকা আলোচনা যখন পরিকল্পনামাফিক হয় না
বিবিসির চীন সংবাদদাতা স্টিফেন ম্যাকডোনেল বলেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে বৈঠকগুলো সাধারণত অনেক বেশি আনুষ্ঠানিক, দ্বাররুদ্ধ এবং একঘেয়ে হয়ে থাকে- কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় অ্যাঙ্কোরেজ শহরে যে বৈঠকটি হয়েছিল সেটি একটি ভিন্ন ছিল।
বাইডেনের শাসনামলে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রথম এ ধরণের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে, শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক কথাবার্তা হয়েছে।
আলাস্কায় ওই বৈঠকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপস্থিতিও অবশ্য ছিল: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান, চীনের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ও পলিটব্যুরো সদস্য ইয়াং জিয়েচি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
সেখানে “আমাদের দুই মহান জাতি এক সাথে কাজ করছে” এরকম কোন কথাবার্তা ছিল না। বরং শুরুতেই সাইবার হামলা, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব, হংকংয়ের অভিযান এবং শি জিন পিংয়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের মতো অভিযোগ এসেছে।
ইয়াং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে যে, তারা “আমেরিকা সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করে দীর্ঘ দিন ধরে এখতিয়ার চালিয়েছে এবং অন্য দেশগুলোকে দম করেছে।”