জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত লক্ষ্য অর্জনে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আজ সময় এসেছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৩ ও অভীষ্ট-১৭-এর আলোকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার। যে প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হবে জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা।’
এই উদ্দেশ্য পূরণে সুস্পষ্ট বৈশ্বিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি লক্ষ্য-অভিমুখী, নিবেদিত কূটনৈতিক তৎপরতার কোন বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত ‘জনস্বাস্থ্য ও কূটনীতি’ বিষয়ক দু’দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং কভিড-১৯ মহামারির প্রভাব মোকাবেলায় অতীতের সাফল্য বিবেচনা করে বাংলাদেশ এই প্রচেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
সরকার প্রধান আরো বলেন, ‘কভিড-১৯ মহামারি প্রমাণ করেছে, আমরা যতই নিজেদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবি না কেন, আমাদের সকলের ভাগ্য আসলে একসূত্রে গাঁথা। আমরা কেউই সুরক্ষিত নই যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি।’
বৃহত্তর স্বার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মন্ত্রী ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরেন।
প্রথমত; তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত; সুপারিশে তিনি বলেছেন, নিরাময়যোগ্য সংক্রামক রোগ নির্মূল করতে এবং ক্রমবর্ধমান অসংক্রামক রোগের বিস্তাররোধে বিদ্যমান উত্তম চর্চা বিনিময়ে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্যকে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলধারায় যুক্ত করতে এবং পানিতে ডুবে যাওয়া ও দুর্ঘটনার মত প্রাণঘাতী জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধে আমাদের মনোযোগী হতে হবে বলে তিনি তার তৃতীয় সুপারিশে উল্লেখ করেন।
চতুর্থত; তিনি বলেন, আমাদের নিজ নিজ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে, বিশেষকরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেড়ে যাওয়া বিভিন্ন গ্রীষ্মম-লীয় রোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেষ ও পঞ্চম সপুারিশে বলেছেন, মা, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৩ অর্জনের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে এ অঞ্চলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আগামী ৭৫ বছর এবং তারও পরে যেন অর্থপূর্ণভাবে সমগ্র মানবতার সেবা করে যেতে পারে সে লক্ষ্যে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ১১ সদস্য রাষ্ট্র হলো বাংলাদেশ, ভুটান, গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও তিমুর-লেস্তে।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক, মিয়ানমারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. থেতখাইং উইন, ভুটানের স্বাস্থ্য মন্ত্রী লিয়নপো দাশো দেচেন ওয়াংমো, মালদ্বীপের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী সাফিয়া মোহাম্মদ সাইদ, থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী বিজয়ভাত ইসরাভাকদি এবং বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ড. বরদান জং রানা বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার এবং সূচনা বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে একটি অডিও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনাও প্রদর্শিত হয়।
২০২০ সালের শুরুর দিকে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে তাঁর দেশ মানুষের প্রাণহানি হ্রাস এবং অর্থনীতি সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে।
উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায়, বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ে টিকা ক্রয় এবং প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশের শতভাগ লোককে বিনামূল্যে কভিড-১৯ টিকা প্রদান করেছি।
তিনি বলেন, সামগ্রিক কভিড ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও রয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন যে, এমনকি চ্যালেঞ্জিং কভিড-১৯ মহামারি চলাকালীনও বাংলাদেশ প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আশ্রয় চাওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের কথা ভুলে যায়নি।
তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় বাংলাদেশ তাদের নিয়মিত চেক-আপ, টিকাদান এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তবে এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, আমাদের দেশে বসবাসরত এই বিশাল জনগোষ্ঠী সবসময়ই আমাদের অঞ্চলের জন্য একটি মানবিক সংকট এবং নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়। মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনই পারে এই সংকটের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে এবং আমি আশা করি যে মিয়ানমার খুব শিগগিরই তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁরা সারা দেশে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ শুরু করেছিল যা প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে তাঁর সরকারের মেয়াদকালের শেষে প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আরও আড়াই হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণাধীন ছিল। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক কর্মসূচি বাতিল করে দেয় এবং এই সুবিধাগুলোর অনেকগুলো অব্যবহৃত হয়ে পড়ে।
২০০৯ সালে, যখন আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে, তারা প্রায় শুরু থেকেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই যে এখন গ্রামীণ এবং শহর উভয় এলাকায় প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি পর্যায়ের স্বা¯্য’ সেবা কেন্দ্র রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবাসহ ৩০টি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এই মুহুর্তে প্রতিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন সেবা-প্রার্থী আসে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ মহিলা এবং শিশু।
তিনি বলেন, সারা দেশে প্রায় ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাভাবিক প্রসবের পরিষেবা প্রদান করে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি আমার এবং আমার দেশের জন্য অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের বিষয় যে সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক বাংলাদেশের উদ্ভাবনী স্বাস্থ্যসেবা মডেলকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং এটিকে ‘শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে।’
তিনি বলেন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। ‘এমডিজি পুরস্কার ২০১০’ হলো শিশুমৃত্যু হ্রাসে সাফল্যের একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ শিশুদের প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে রক্ষা করতে টিকাদানের সম্প্রসারিত কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ইউনিসেফের মতে, কভিডের সময়কালে শিশুদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল।
একই সঙ্গে শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল ও অ্যান্থেলমিন্টিক ট্যাবলেট নিয়মিত খাওয়ানো হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিও ও টিটেনাস মুক্ত ঘোষণা করেছে। কুষ্ঠরোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে, কালো জ্বর এখন প্রায় বিলুপ্ত। যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়া নিয়ে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য হটলাইনসহ সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে টেলিমেডিসিন পরিষেবা চালু করা হয়েছে।
সরকার প্রধান আরও বলেন, মা টেলিহেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্বকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
প্রায় ৩৫০টি স্বাস্থ্য-প্রযুক্তি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য একটি স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তৈরি করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিজম এবং নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি কমাতে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে এবং এই ট্রাস্টের অধীনে ‘বঙ্গবন্ধু ইনস্যুরেন্স ফর পার্সন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস’ চালু করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য দেশের ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সহায়তা কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। আরও ২১১টি কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।