অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদের হত্যাকারী মহিউদ্দিন-জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন (৫৫) ও জাহাঙ্গীর আলমের (৩৫) ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে শিক্ষক হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
কারাবিধি অনুযায়ী দুইজনের ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল। দুইজনের ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ আলমগীর হোসেন। তাকে সহায়তা করেন জল্লাদ নাজমুল, সুমন, উজ্জ্বল, নাসির ও রিয়াজুল।
ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ড. এস তাহের আহমেদের মেয়ে আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ ও স্ত্রী সুলতানা আহমেদ।
মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। তার বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জানদি গ্রামে। বাবার নাম মিয়া আব্দুল মানান।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীর আলম রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানার খোজাপুর মধ্যপাড়ার আজিমুদ্দিন মুন্সির ছেলে।
ফাঁসি কার্যকরের পর মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। দুটি পৃথক অ্যাম্বুলেন্সে মহিউদ্দিনের মরদেহ ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও জাহাঙ্গীরের মরদেহ তার গ্রাম খোজাপুর মধ্যপাড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে গত ২৫ জুলাই দুই আসামির স্বজনরা কারাগারে শেষ সাক্ষাৎ করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়। রাত ৯টার পর একে একে কারাগারে আসেন ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেন, রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সাবিহা সুলতানা, রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক এবং রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা।
দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় রাজশাহী মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সন্ধ্যার পর থেকে কারাগার এলাকায় অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
কারাগারের একটি সূত্র জানায়, কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গণপূর্ত অধিদপ্তর অন্তত ১৫ দিন আগে আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুতির কাজ শুরু করে। মৃত্যুকূপটি দীর্ঘদিনের পুরনো। তাই তারা সংস্কার করে। কারাগারের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের পাশে উন্মুক্ত ফাঁসির মঞ্চটি।
এছাড়াও যে দড়িতে ঝুলানো হয় সেটি আসামিদের তিনগুণ ওজনের বস্তু বেঁধে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফাঁসির দড়িটিও চূড়ান্ত করা হয়। প্রথমে ১৭ জন কয়েদিকে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে কারা কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আটজনকে চূড়ান্ত করা হয়। এরা হলেন- আলমগীর, নাজমুল, সুমন, উজ্জ্বল, নাসির, মজনু, আশরাফুল ও রিয়াজুল। এদের মধ্যে প্রধান জল্লাদ আলমগীর হোসেন। তিনি একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। আলমগীর এর আগেও জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। জল্লাদ দলের দুইজন নতুন সদস্য ছিলেন।
উজ্জ্বল পুঠিয়ার আলোচিত মহিমা ধর্ষণ মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাদের প্রশিক্ষণ ও ফাঁসি কার্যকরের একাধিক মহড়া দেওয়ানো হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আটজনের মধ্যে টিম প্রধান হেন্ডেল টেনে ফাঁসি কার্যকর করেন। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজন দুই আসামিকে ধরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। আর দুইজন তাদের কালো কাপড়ের জম টুপি ও গলায় দঁড়ি পরিয়ে দেন। এর আগে সকাল থেকে মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের কয়েক দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে কারা কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পশ্চিম আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক সৈয়দ তাহের আহমেদ। বাসাটিতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বাসাটির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় অধ্যাপক তাহের আহমেদের গলিত মরদেহ।
ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। অধ্যাপক তাহের আহমেদের সহধর্মিণী সুলতানা আহমেদ ও মেয়ে আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ ঢাকার ওয়ারীতে বসবাস করেন।
এদিকে অধ্যাপক তাহেরের করা একটি জিডির সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও তৎকালীন রাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহবুব আলম সালেহী বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমসহ আটজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৫ ফেব্রুয়ারি মামলায় গ্রেফতারকৃত তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আদালতে।
জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন।
পরে মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও রাবি শাখা শিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুব আলম সালেহী অধ্যাপক তাহেরের বাসায় যান। মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনকে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ দিতে শিবির নেতা সালেহী অধ্যাপক তাহেরকে জীবননাশের হুমকি দেন। মিয়া মহিউদ্দিনও দেখে নেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন। ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি অধ্যাপক তাহের বিভাগের শিক্ষক মহিউদ্দিন ও শিবির নেতা সালেহীর বিরুদ্ধে মতিহার থানায় একটি জিডি করেছিলেন। এরপরই বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমকে হাত করেন মহিউদ্দিন ও সালেহী। তাকে ২০ হাজার টাকার লোভ দেখানো হয়।
২০০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি গভীর রাতে মহিউদ্দিন ও শিবির নেতা সালেহী কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমের সহায়তায় বাসার ভেতরে প্রবেশ করেন। অধ্যাপক তাহের যে ঘরে ঘুমিয়েছিলেন তার দরজা খোলা ছিল। ঘরে প্রবেশ করে মহিউদ্দিন মুখে বালিশচাপা দেন এবং জাহাঙ্গীর ও শিবির নেতা সালেহী অধ্যাপক তাহেরের দুই পা ও হাত চেপে ধরে রাখেন। এভাবেই নৃশংসভাবে খুন করা হয় অধ্যাপক তাহেরকে।
তিন আসামি জবানবন্দিতে আরও বলেন, বালিশচাপায় খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের লাশ বাসার পেছনে নেওয়া হয়। লাশ গুমের জন্য জাহাঙ্গীর আলম তার ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন খোজাপুর গ্রাম থেকে ডেকে আনেন। তাদের সহায়তায় বাসার পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে অধ্যাপক তাহেরের লাশ ঢাকনা খুলে ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ শিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) আচানুল কবির। এ হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহী বিভাগীয় দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এটিএম মেসবাউদ্দৌলা চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন।
দণ্ডিতরা হলেন- বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, তার ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালাম। বিচারে খালাস দেওয়া হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সিকে। পরবর্তী দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল বিভাগ মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের রায় বহাল রাখলেও আসামি নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামের রায় কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন। তবে আপিলে সাজা কমে যাবজ্জীবন হওয়া দুই আসামির দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখেন।