কলাপাড়ায় চাষাবাদের মৌসুমে সার নিয়ে কৃষকের শঙ্কা
সরকার কৃষকের নিকট সারের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে নীতিমালা প্রনয়নের পরও পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ন্যায্য মূল্যে সার পাচ্ছে না কৃষক। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রনে চড়া মূল্যে বিক্রী হচ্ছে সার। ফলে চাষাবাদের ভরা মৌসুমে সার নিয়ে কৃষকের শঙ্কা যেন কিছুতেই কাটছে না।
এছাড়া বিসিআইসি’র বাফার গুদাম ও বিএডিসি’র গুদাম থেকে সার উত্তোলনের পর তদারকির অভাবে এক উপজেলা থেকে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই সার যাচ্ছে অন্য জেলা, উপজেলায়। এতে সরকারের ভর্তুকী দিয়ে কেনা সার কৃষক নির্ধারিত মূল্যে না পেলেও গত কয়েক বছরে কতিপয় সার ডিলার, কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থের মালিক হয়েছেন।-তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের দাবী, সার নিয়ে কোন শঙ্কা নেই। নির্ধারিত মূল্যে সার পাচ্ছেন কৃষক। আর বিসিআইসি’র বাফার গুদাম ইনচার্জ ও বিএডিসি’র ষ্টোর কিপারের দাবী, বরাদ্দ পত্র, পে-অর্ডার চালান পেয়ে গুদাম থেকে সার দেয়া হয় ডিলারদের। যা তদারকির দায়িত্ব কৃষি অফিস ও সার-বীজ মনিটরিং কমিটির।
সূত্র জানায়, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আ: রহমান কলাপাড়া কৃষি অফিসে যোগ দেন ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে। একই কর্মস্থলে যুগ যুগ ধরে কর্মরত থাকায় ডিলারদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন সার সিন্ডিকেট। কৃষি অফিস, জেলা খামারবাড়ী, সার-বীজ মনিটরিং কমিটি ম্যানেজে বিসিআইসি’র সার ডিলার খান ট্রেডার্সের জাকির খানকে দিয়ে তিনি নিয়ন্ত্রন করছেন সিন্ডিকেট।
স্থানীয় উত্তরা ব্যাংকের শাখায় সিন্ডিকেটের নামে ৩২১০১১১০০১২২০৫৮ নং সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়েছে। যা আ: রহমানের নির্দেশনায় পরিচালনা করে সিন্ডিকেট। উত্তরা ব্যাংকের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের লেনদেনের তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ার পর থেকে লেন দেন চলছে লিক্যুইড ক্যাশে।
সূত্রটি আরও জানায়, উপজেলার একাধিক বিসিআইসি’র সার ডিলারের লাইসেন্স বাৎসরিক ভিত্তিতে ভাড়া নিয়ে খান ট্রেডার্স দীর্ঘদিন সার ব্যবসা করলেও, কৃষি অফিসের তথ্যে সার উত্তোলন ও বিক্রী করেছে স্ব স্ব লাইসেন্সধারীরা। এরপর ২০১৯-২০ অর্থ বছরে খান ট্রেডার্স সহ বিসিআইসি’র নতুন ৭জন ডিলার নিয়োগে বিদায়ী কৃষি কর্মকর্তা আ: মান্নান এর সাথে খান ট্রেডার্সের গোপন সখ্যতার তথ্য ফাঁস হলেও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রনে থাকে সবকিছু। পদোন্নতি পেয়ে পুরস্কৃত বদলী নেন আ: মান্নান। এরপর নতুন কৃষি কর্মকর্তা এআরএম সাইফুল্লাহ যোগ দেন কলাপাড়ায়, আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট। এর আগে সার কেলেংকারিতে কলাপাড়া কৃষি অফিসের দুই উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও সার ডিলারের নামে মামলা হলেও আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যান তারা।
সূত্র মতে, কলাপাড়ায় বিসিআইসির ১৪ জন ডিলার রয়েছে। কার্ডধারী খুচরা বিক্রেতা রয়েছে ১১৮ জন। সরকারি নির্দেশনায় কৃষকের কাছে ২৭ টাকা কেজি দরে ইউরিয়া সার, টিএসপি ২৭, ডিএপি ২১ এবং এমওপি ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার নিয়ম থাকলেও কৃষককে সার কিনতে হচ্ছে ২৮-৩০ টাকা কেজি দরে। বিসিআইসি ডিলারদের লাল সালু টানিয়ে ন্যায্য মূল্যে সার বিক্রীর নির্দেশনা থাকলেও নিয়ম মানছেনা কেউ। প্রতিবস্তা ইউরিয়া সার সরকারী মূল্য ১৩৫০ টাকার পরিবর্তে বিক্রী করা হচ্ছে ১৪০০-১৪৫০ টাকা মূল্যে, ডিএপি সার ১০৫০ এর পরিবর্তে বিক্রী করা হচ্ছে ১৩৫০ টাকা মূল্যে এবং টিএসপি সার ১৩৫০ এর পরিবর্তে বিক্রী করা হচ্ছে ১৯০০ টাকা মূল্যে। বিসিআইসি’র ডিলার সহ খুচরা বিক্রেতাদের গুদামেও মজুদ করা হচ্ছে বৈধ, অবৈধ উৎস্য থেকে কেনা সার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রবিশষ্য মৌসুমে সারের চাহিদা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় ডিলারদের বরাদ্দকৃত ইউরিয়া সার বরিশাল বিসিআইসি বাফার গুদাম ও টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সার বরগুনা বিএডিসি গুদাম থেকে উত্তোলনের পর স্ব স্ব ডিলার গুদামে না নিয়ে চড়া মূল্যে বিক্রী হয় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছে।
এমন অভিযোগের তথ্য যাচাইয়ে কৃষি অফিসে গেলে অসৌজন্যমূলক আচরন সহ সাংবাদিকদের নিয়ে কটুক্তি করে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে বলেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আ: রহমান। কিন্তু লিখিত আবেদন করার পরও নির্ধারিত সময়ে গত ৫ বছরের সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভার রেজুলেশন কপি ও বরাদ্দ পত্র, গুদাম থেকে সার উত্তোলনের চালান কপি, পরিবহন খরচ ভাউচার, ডিলার গুদামে সারের আগমনী রিপোর্ট, খুচরা ডিলারদের মাঝে বন্টন ও বিক্রী সংক্রান্ত তদারকির তথ্য মেলেনি। বিষয়টি উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি সহ জেলা কমিটির সদস্য সচিবকে অবগত করেও ফল হয়নি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মহিপুর ইউনিয়নের খুচরা সার ডিলার মিজান ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী আ: রশিদ খান মারা যান বেশ ক’বছর আগে। সেই থেকে তার লাইসেন্সের বরাদ্দ ছাড় হচ্ছে প্রতিমাসে। লতাচাপলি ইউনিয়নের খুচরা ডিলার রশিদ সর্দার, আশরাফুজ্জামান বাবু, রিয়াজ মোর্শেদ, জুলহাস খান জালাল’র লাইসেন্স ১ লক্ষ টাকা অগ্রিম ও মাসিক ভাড়ায় নিয়ে ধীর্ঘদিন ধরে সার ব্যবসা করছেন মধ্যস্বত্ত্বভোগী রুবেল, শহিদ মুসুল্লী, বশির মোল্লা, জাহাঙ্গীর মুসুল্লী। উপজেলার সর্বত্র এমন চিত্র। লতাচাপলি ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার রতন তালুকদার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে মারা যাওয়ার পর নীতিমালা অনুযায়ী পাশর্^বর্তী ইউনিয়নের ডিলারকে না দিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এআরএম সাইফুল্লাহ উক্ত লাইসেন্সের বরাদ্দের সার দেন পৌরশহরের খান ট্রেডার্সকে। অথচ লতাচাপলিতে আবাদি জমি রয়েছে ৩৭৪০ হেক্টর, নীলগঞ্জে ৩৮৯৫ হেক্টর।
উপজেলার ধূলাসার ইউনিয়নের নতুনপাড়া গ্রামের কৃষক ইউনুস বলেন, ’বাজার থেকে ১ বস্তা সাদা ইউরিয়া ১৪০০ টাকায়, ডিএপি ১৩০০ টাকা, টিএসপি ১৯০০ টাকা, ১ কেজি ফাতারা ঔষধ ৩০৮ টাকা এবং ওয়ান ষ্টপ ১০০ গ্রাম ঔষধ ৩৪০ টাকায় কিনেছি। ক্যাশ মেমো চেয়েও পাইনি।’
বিসিআইসি’র বাফার গুদাম ইনচার্জ মো: শাহে আলম গাজী বলেন, ’সার ও বীজ কমিটির বরাদ্দ পত্র, পে-অর্ডার চালান পেয়ে গুদাম থেকে সার দেয়া হয় ডিলারদের। ডিলাররা সার উত্তোলনের পর তাদের কাছে সংগ্রহের চালান দিয়ে দেয়া হয় গুদাম থেকে। ’ বিএডিসি’র গুদাম ইনচার্জ মোসা: লাইজু বেগমকে মুঠো ফোনে একাধিক বার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে ষ্টোর কিপার মো: জাহিদ বলেন, ’গুদাম গেটের বাইরে সার নিয়ে কোন ধরনের অনিয়ম হলে আমাদের কোন দায় নেই।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এআরএম সাইফুল্লাহ জানান, সারের কোথাও কোন সঙ্কট নেই। আগস্ট মাসের বরাদ্দকৃত ১২৪২ মেট্রিকটন ইউরিয়া সার ডিলাররা উত্তোলন করেছেন। সেপ্টেম্বরে বরাদ্দ রয়েছে ১১৭৮ মেট্রিকটন সার। কেউ যদি সার নিয়ে অনিয়ম করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি, কলাপাড়া ইউএনও মো: জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,’গত ৬ মাসে কৃষি অফিস সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির মাত্র একটি সভা করেছে। সার সাংক্রান্ত বিষয়ে তারা আমাকে কোনকিছু অবগত করেনি। কমিটির সভায় সার বিক্রী তদারকিতে ইউপি সচিবদের ট্যাগ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।’