ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনসহ যেসব যুদ্ধাস্ত্র যোগ হয়েছে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে গত পাঁচ বছরে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম ও মানববিহীন ড্রোনসহ অন্তত ২৩ ধরনের নতুন আধুনিক প্রযুক্তির যুদ্ধ সরঞ্জাম সংযোজন করা হয়েছে । জাতীয় সংসদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের দেয়ার এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। চীন ও তুরস্কসহ ১২টি দেশ থেকে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ এসব যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করেছে।
এর মধ্যে সেনাবাহিনীর জন্য ১১ ধরণের, নৌবাহিনীর জন্য আট এবং বিমান বাহিনীর জন্য চার ধরণের যুদ্ধ সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে।
কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব:) সুবিদ আলী ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এর আওতায় সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে তার অংশ হিসেবে এসব যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করা হয়েছে।
“আমাদের সশস্ত্র বাহিনী যেন যে কোন সময় যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী ফোর্সেস গোল ২০৩০ নির্ধারণ করেছেন। বিবেচনা করতে হবে যে যুদ্ধ আমরা করব না, কিন্তু তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে যাতে করে দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত হয় সেজন্য যা যা দরকার তাই করা হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. ভুঁইয়া।
কমিটির ওই বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে নতুন যুদ্ধাস্ত্রের বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়া হলেও এগুলো নিয়ে বিস্তারিত কোন আলোচনা হয়নি।
এসব অস্ত্র ক্রয়ে কত টাকা ব্যয় হয়েছে কিংবা যে ১২টি দেশ থেকে কেনা হয়েছে তাদের কিসের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়েছে তা নিয়ে কোন সদস্য কোন প্রশ্ন করেননি।
সামরিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব. ) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলছেন, সামরিক উপকরণ কেনার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর যথাযথ প্রক্রিয়া আছে এবং তারা নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে এসব ক্রয় করে ।
“ যেগুলো আনা হয়েছে এগুলো দরকার ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে, যা সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিরোধক সক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. শিকদার।
সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়ন করছে সরকার।
কী কী যুদ্ধাস্ত্র সংযোজিত হয়েছে?
সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিবেদন অনুযায়ী সেনাবাহিনীর জন্য সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম আনা হয়েছে চীন থেকে। মোহাম্মদ আলী শিকদারের মতে এর ফলে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরিচিতি ঘটলো বাংলাদেশের।
যদিও এর রেঞ্জ কত বা এটি কোন পাল্লার সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এরপরেও এটিকে সেনাবাহিনীর জন্য একটি ‘বড় ধরণের অগ্রগতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ট্যাংক উদ্ধার করে এনে মেরামত করে আবার তা যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর জন্য জার্মানি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে আর্মার্ড রিকভারি ভেহিক্যাল ফর ট্যাঙ্ক।
যেটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে তা হলো আনম্যানড এরিয়াল ভেহিক্যাল বা ইউএভি। এটি হচ্ছে মানববিহীন ড্রোন। এটি সংগ্রহ করা হয়েছে তুরস্ক থেকে।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ মান্নান তুর্কি সংবাদমাধ্যম আনাদুলু এজেন্সিকে এক সাক্ষাৎকারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ওই বছর জুনে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য তুরস্কের সাথে চুক্তিও করেছিল বাংলাদেশ।
এখন সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে মানববিহীন ড্রোন ছাড়াও তুরস্ক থেকে সেনাবাহিনীর জন্য বিভিন্ন ধরণের আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার, মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম এবং রেজিমেন্ট ফিল্ড আর্টিলারি ওয়েপন সিস্টেম সংগ্রহ করা হয়েছে।
ওদিকে এই সময়ের মধ্যে নৌবাহিনীর জন্য চীন থেকে ফ্রিগেট, বিভিন্ন ধরণের মিসাইল ও উপকরণ ছাড়াও চীনের সহায়তা নৌঘাঁটি শেখ হাসিনার সাবমেরিন বেইজ নির্মাণ এবং নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ডের জন্য উপকরণ, প্রশিক্ষণ ও অন্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
আর ইটালি থেকে ইউটিলিটি হেলিকপ্টার এনেছে নৌবাহিনী এবং কানাডা থেকে এসেছে অবকাঠামোসহ স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক সিস্টেম।
অন্যদিকে বিমান বাহিনীর জন্য যুক্তরাজ্য থেকে আনা হয়েছে এমকে৫ এয়ারক্রাফট, ফ্রান্স থেকে এয়ার রাডার, ইটালি থেকে মানববিহীন ড্রোন এবং জার্মানি থেকে প্রশিক্ষণ বিমান।
মোহাম্মদ আলী শিকদার বলছেন যেসব দেশ থেকে যা যা আনা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক এসব উপকরণের জন্য তারা সুপরিচিত।
এর আগে চলতি বছরের ৪ঠা জুলাই সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন যে বিমানবাহিনীতে বর্তমানে আট স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান রয়েছে। ভবিষ্যতে বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়নের জন্য ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’–এর আলোকে উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
এছাড়া নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিনসহ ছোট–বড় ৬৫টির বেশি যুদ্ধজাহাজ, দুটি হেলিকপ্টার ও চারটি মেরিটাইম এয়ারক্রাফট আছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
ফোর্সেস গোল ২০৩০
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১২০ কিলোমিটার রেঞ্জে ফায়ারিং হয়েছিল কক্সবাজারের শিলখালী ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে।
এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন সংযোজিত তুরস্কের তৈরি টাইগার মিসাইল সিস্টেম আমাদের আভিযানিক সক্ষমতাকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা”।
আর সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর জন্য এসব যুদ্ধ সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হয়েছে মূলত ফোর্সেস গোল-২০৩০ কর্মসূচি গ্রহণের পর।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার আসার পর এ কর্মসূচিটি প্রণয়ন করা হয়েছিলো।
মূলত বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে নতুন করে ফোর্সেস গোল প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। পরে ২০১৭ সালে এটিকে কিছুটা পরিমার্জনও করা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রতি বছরেই সামরিক ব্যয়ও বেড়েছে বাংলাদেশের। চলতি বছরের বাজেটেও প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি।
মোহাম্মদ আলী শিকদার বলছেন, সশস্ত্র বাহিনীর যুদ্ধ উপকরণে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এবং নতুনত্ব এসেছে, যার ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা অনেক গুণ বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা
সামরিক খাত নিয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং গবেষণা করে, বিশ্বে সুপরিচিত এমন একটি প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার প্রতি বছর সামরিক শক্তির বিচার করে একটি তালিকা প্রকাশ করে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাদের প্রকাশ করা র্যাংকিং অনুযায়ী ১৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ৪০ তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে তারা চতুর্থ স্থানে রেখেছিলো।
পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালে তাদের তালিকা অনুযায়ী তখন বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ৫৬তম।
অর্থাৎ পাঁচ বছরে সামরিক শক্তির বিবেচনায় এ তালিকায় বাংলাদেশ ১৬ ধাপ এগিয়ে আসার অগ্রগতি অর্জন করেছে।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১ লাখ ৭৫ হাজার সেনা, বিমান বাহিনীতে প্রায় ২১ হাজার সেনা আর নৌ বাহিনীতে আছে প্রায় ত্রিশ হাজার।