বিএনপির সাবেক নেতাদের দলগুলোকে কি বিকল্প হিসেবে ভাবছে আওয়ামী লীগ

শেয়ার করুন

বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ছোটখাটো দলের তৎপরতা নিয়ে রাজনীতিতে নানা আলোচনা চলছে। অনেকক্ষেত্রেই এই দলগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং সরকারের ‘আর্শিবাদপুষ্ট’ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।

অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ছাড়াই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত কোন সমঝোতা চেষ্টা দৃশ্যমান হয়নি।

পর্যবেক্ষকদের অনেকে ধারণা করছেন, ছোট ছোট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নানা সুবিধা দিয়ে নির্বাচনে এনে ক্ষমতাসীনরা দেখাতে চায় যে নির্বাচনে অনেক দল অংশ নিয়েছে এবং সেটি ‘অংশগ্রহণমূলক’ হয়েছে।

যেসব ছোট ছোট দলের তৎপরতা সম্প্রতি দৃশ্যমান হয়েছে তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং অপরটি হচ্ছে তৃণমূল বিএনপি।

যেসব ছোট দল নির্বাচনে আসার কথা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে দুটো বিষয় লক্ষ্য করা যায়।

কোন কোন দলের নেতার পরিচিতি আছে। অনেকের ভাষায় সেগুলো ‘এক ব্যক্তির এক দল’। আবার কোন দলের নেতা কিংবা দল সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই অপরিচিত।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় সেটি হচ্ছে – এসব দলের মধ্যে যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা অতীতে বিএনপি কিংবা একাধিক রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন।

প্রধান বিরোধী দল ছাড়া ছোটখাটো দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

“এরা কিন্তু ছোট দলগুলোর মধ্যেও ছোট দল। এদেরকে মনে হয় ভুঁইফোড় দল বলাটাই যুক্তিযুক্ত। বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলে প্রশ্ন থেকেই যাবে। কারণ বিএনপি হচ্ছে বাংলাদেশের আসল বিরোধী দল,” বলছিলেন আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমস-এর অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ।

তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলে সে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে ক্ষমতাসীনরা দাবি করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেটা গ্রহণ করবে না।

“নির্বাচনের শুধু আইনগত ভিত্তি থাকলে হয়না, এটার নৈতিক ভিত্তিও প্রয়োজন,” বলেন মি. আহমেদ।

তবে ক্ষমতাসীনরা আপাতত নির্বাচনের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করছে। আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু থাকবে সেদিকে তারা নজর দিচ্ছেন না।

তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, যত বেশি সংখ্যক ভোটার নির্বাচনে ভোট দেবে, নির্বাচন তত বেশি অংশগ্রহণমূলক হবে।

“আমরা একদিকে এটাও চাই যে সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। আবার অন্যদিকে এটাও মনে করি, সবদল অংশ করলো কি করলো না, তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে কী না,” বলছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন।

প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে না থাকলে ক্ষমতাসীনরা কি আন্তর্জাতিক মহলকে বোঝাতে পারবে যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে?

“দেখুন ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি তো আমাদের কথায় কনভিন্সড হয়না। তাদের নিজস্ব কৌশল ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে,” বলেন মি. লেলিন।

ছোট দলগুলো কী বলছে?

তৃণমূল বিএনপির নেতা শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী আমলা ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এরপর তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর তিনি বিএনপি ছেড়ে বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন। বিকল্পধারা বাংলাদেশ ছেড়ে মি. চৌধুরী এখন তৃণমূল বিএনপিতে।

মি.চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি সিলেট ৬ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। এছাড়া যত বেশি সম্ভব ততবেশি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে চায় তৃণমূল বিএনপি।

নির্বাচনে অংশ নেবার ব্যাপারে তারা সরকারের সাথে কোন সমঝোতা করেছেন কিনা কিংবা আসন ছেড়ে ছেড়ে দেবার বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা কোন সুবিধা দেবে কী না – এসব প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

“এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমি বিশ্বাস করি নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে। সেজন্যই আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি,” বলেন মি, চৌধুরী।

বিএনএম এর নেতা শাহ মো. আবু জাফর একসময় শ্রমিক নেতা ও বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তাদের দল নির্বাচনে যাচ্ছে। তিনি নিজে ফরিদপুর ১ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান।

কেন তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন? এমন প্রশ্নে মি. জাফর বলেন, “এখন যে ন্যাশনাল-ইন্টারন্যাশনাল প্রেশার তাতে মনে হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ”

নির্বাচনের আগেই যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে

গত শনিবার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা

ছোট দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ক্ষমতা থাকতে আওয়ামী লীগের কোন সমস্যা হয়নি। অতীতে দুটো নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় এসব দলের অনেকের মধ্যে এ ধারণা আরো জোরালো হয়েছে।

অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, এসব দল নির্বাচনে আসার পেছনে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সুবিধা নেবার বিষয়টি জড়িত থাকতে পারে। আবার সরকারের চাপে পড়েও অনেকে নির্বাচনে আসতে পারে।

কিন্তু এসব কথা মানতে নারাজ ছোট দলগুলোর নেতারা।

“যার যার কথা সে বলবে। আমাদের বিষয়টা যারা আড়চোখে দেখবে তারা তো এ ধরণের কথা বলবেই,” বলছিলেন বিএনএম নেতা শাহ মো. আবু জাফর।

আওয়ামী লীগ নেতা নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, ছোটখাটো দলকে নির্বাচনে আনার জন্য বোঝাতে কিংবা চাপ প্রয়োগ করতে হয়না।

“এসব দল গজিয়ে ওঠে নির্বাচন করার জন্য। এখানে আওয়ামী লীগকে বেনিফিট (সুবিধা) দেবার কিছু নেই। আওয়ামী লীগ তো চায় সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. লেনিন।

বিএনপি মনে করছে, সেসব ছোটখাটো দল নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে সেটা তাদের মাথাব্যথার কারণ নয়।

নির্বাচন নিয়ে সরকারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়টিকে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না- এখনো পর্যন্ত তারা এ দাবিতে অনড় আছে। তারা মনে করছে, বিএনপিতে যারা ‘অপ্রয়োজনীয়’, ‘নিষ্ক্রিয়’ কিংবা ‘গুরুত্বহীন’ ছিলেন তারা অনেক জায়গায় ভিড়েছে।

“বিএনপির দাবি জন-দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোন সুযোগ আমরা দেখছি না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল।

“সরকার যেনতেন ভাবে একটা নির্বাচন করে ক্ষমতায় নবায়ন করতে চায়। ছোটখাটো দল যেসব আছে তারা প্রত্যেকটা নির্বাচনে অন্য দলের উপর নির্ভর করে নির্বাচন করে,” বলেন মি. কামাল।

ছোট দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিএনপির জন্য নেতিবাচক কিছু হবে বলে মনে করেন না বিশ্লেষকরাও। কিন্তু সার্বিক প্রেক্ষাপটে আসছে নির্বাচন বিএনপির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার বলেন, বিএনপি এখন সবচেয়ে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা গত ১৭ বছর প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রাজনীতি করছে।

“বিএনপির মতো দলেও সুবিধাবাদী একটি অংশের অবস্থান রয়েছে। তারা মনে করে রাজনীতি মানে কিছু প্রাপ্তি। ফলে দীর্ঘদিন সে প্রাপ্তি না থা থাকা এবং সরকারের চাপ – ইত্যাদি নানা কিছু মিলে বিএনপির সামনে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে ২০২৪ সালের নির্বাচনটা যদি হয়ে যায়,” বলেন মি. আহমেদ।

তিনি মনে করেন, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং এরপর সরকার যদি তার ধারাবাহিকতা রাখতে পারে তাহলে সেটা বিএনপির মধ্যে হতাশার তৈরি করবে।


শেয়ার করুন

Similar Posts