কলাপাড়ায় ঝূঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উপকূল বাসী আতঙ্কে

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপকূলীয় এলাকার সিডর ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ এখনও টেকসই ভাবে নির্মাণ না হওয়ায় শুধু ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা নয় বর্ষায় নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেও বাঁধে ভাঙন তৈরি হয়, বাঁধ ভাঙে। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। নষ্ট হয় ঘরবাড়ি ফসল। ভিটেবাড়ি হারিয়ে নি:স্ব হয় মানুষ। ভাসিয়ে নেয় হাজারো মানুষের বসতি, কেড়ে নেয় জীবন-জীবিকা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখন কলাপাড়া উপকূলীয় এলাকা বসবাসের জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। টেকসই বাঁধের অভাব এ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। জীবন-জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে উপকূলীয় বিভিন্ন অঞ্চলে বাঁধের জন্য মানুষের আকুতির শেষ নেই। স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করলেও তা বেশি দিন থাকছে না।
জানা যায়, কলাপাড়া উপজেলার আয়তন ৪৯২.১০ বর্গ কি.মি.। ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভা, ২৪৪টি গ্রাম রয়েছে এখানে। সম্প্রতি নিম্নচাপের প্রভাবে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করে নদীর তীরবর্তী ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। বর্ষা মৌসুমের আগেই রামনাবাদ, আন্দারমানিক ভাঙ্গনে দিশেহারা নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হতে শুরু করেছে বসতভিটা আবাদী জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ বেড়িবাঁধই খুব নাজুক। প্রলয়নকারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এসব বেড়িবাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও দুর্নীতি অনিয়মের কারণে টেকসই ভাবে নির্মাণ করা যায়নি। এখনও বেড়িবাঁধের কোথাও কোথাও মাত্র দুই থেকে তিন ফুট চওড়া মাটির বাঁধ রয়েছে। এমন দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে যেতে পারে-এই আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন উপকূলবাসী। আসছে বর্ষা মৌসুমের আগেই বাঁধ নির্মানের দাবি জানান ভুক্তভোগী মানুষ। এতে যদি নিজেদের শ্রম দিতে হয় তাতেও তারা রাজি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কলাপাড়া’র তথ্য অনুযায়ী, কলাপাড়া উপজেলার ৫৪/এ পোল্ডারের ১৩.০০ কি.মি. থেকে ১৪.১২০ কি.মি. পর্যন্ত মোট ১,১২০ মিটার বেড়িবাঁধ রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব বসানো হয়। এ প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চম্পাপুর ইউনিয়নে করমজাতলা গ্রামে রাবনাবাদ নদী পাড়ে বেড়িবাঁধ রক্ষায় দেওয়া হয়েছে জরুরি জিওব্যাগ ও টিউব। তাও আবার চার মাসের মাথায় বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ধস। ঢেউয়ের আঘাতে ব্যাগ ছিঁড়ে বের হয়ে গেছে বালু। আর বাঁধের স্লোপ ধ্বসে পড়েছে। এমন অবস্থা হয়েছে করমজাতলা গ্রামে রাবনাবাদ নদী পাড়ের ৫৪/এ পোল্ডারের।
এদিকে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্কে বেড়ে গেছে। এখন আকাশে মেঘ দেখলেই আতকে উঠেন তারা। কারণ, এসব মানুষেরা স্বচক্ষে দেখেছেন বিভিন্ন সময়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা। তাঁদের আশঙ্কা, যে কোনো সময় মূল বাঁধটি ধসে গিয়ে প্লাবন হতে পারে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রটেকশনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের জিও ব্যাগ ও পুরনো ছেঁড়া জিও টিউব। এতে নদীর ঢেউয়ের আঘাতে ব্যাগ ছিঁড়ে বালু বের হয়ে গেছে, আর বাঁধের স্লোপ দ্রুত ধ্বসে পড়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, এভাবে চললে পুরো বাঁধ বর্ষা আসার আগেই বিলীন হয়ে যেতে পারে। এ দিকে আন্দারমানিক নদীর নিজামপুর এলাকায় বেড়িবাঁধ রক্ষায় দেওয়া জরুরি জিও ব্যাগ ও টিউব-এ চার মাসের মাথায় ধ্বস দেখা দিয়েছে। এতে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আতঙ্কে পড়েছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। তারা বলছেন, এই অবস্থায় যে কোনো সময় মূল বাঁধও ধ্বসে যেতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দার জানান, প্রতিবছর বর্ষা আসলেই রামনাবাদ নদীর ভাঙনে আতঙ্কে থাকেন তারা। এ ছাড়া পূর্ণিমা, অমাবস্যা কিংবা অতিবৃষ্টি হলেই নদীপাড়ের এসব মানুষের দূর্ভোগ বেড়ে যায়। অথচ দীর্ঘদিনেও এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হয়নি। তাদের দাবি সরকারি উদ্যোগে দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মানের। তা না হলে যে কোনো সময় বাঁধের আশ পাশের গ্রাম গুলো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। একই সাথে তারা অভিযোগ করেন রামনাবাদ নদীতে বছরের পর বছর ড্রেজিংয়ের কারণে এখানে ভাঙন আরও বেড়েছে।
করমজাতলা গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা দেখেছি, অনেক গুলো টিউব ছেঁড়া। নিচে জিও ব্যাগ না থাকায় সাপোর্টও ছিল না। বর্ষা নামলে বড় বিপদ হবে।
অপর বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, রামনাবাদ নদীতে বছরের পর বছর ড্রেজিংয়ের কারণে এখানে ভাঙন আরও বেড়েছে। অথচ জরুরি প্রোটেকশনের টেকসই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নিজামপুর গ্রামের ইসাহাক হাওলাদার বলেন, আমাদের বেড়িবাঁধ তিনবার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে, এখন আমরা স্হায়ী বেড়িবাঁধ চাই।
পাউবো’র কলাপাড়া’র উপসহকারী প্রকৌশলী বিদ্যা রতন সরকার বলেন, ওই স্পটটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে প্রটেকশন দেওয়া হয়েছিল। মাটি সংকট ছিল, অনেক দূর থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। তবুও আমরা কাজটি সুন্দর ভাবে করেছি। তবে তিনি স্বীকার করেন, স্পটটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেখানে স্থায়ী প্রটেকশনের জন্য ব্লক বসানো দরকার।
পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ আলম ভূঁইয়া জানান, ওই জায়গাটা ক্রিটিক্যাল। ভেতরে জায়গা নেই, মাটিরও সংকট। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ছাড়া এখানে ভাঙন রোধ করা সম্ভব নয়।