ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরান হামলা যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কতটা বৈধ?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহান্তে ইরানের কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নির্দেশ দেওয়ার পর, ডেমোক্র্যাটদের পাশাপাশি তার নিজের দলের অনেক আইনপ্রণেতাও এই সিদ্ধান্তের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান থমাস ম্যাসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, এই হামলা “সংবিধান অনুযায়ী বৈধ নয়”।
আরেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ওয়ারেন ডেভিডসন লিখেছেন, “এটা সাংবিধানিকভাবে বৈধ—এমন কোনো যুক্তিই কল্পনা করাই কঠিন।”
তবে, প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসন ট্রাম্পের পক্ষ নিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “তিনি (ট্রাম্প) মনে করেছিলেন যে তৎক্ষণাত ঝুঁকি এতটাই বড় ছিল যে, কংগ্রেসের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করার সময় ছিল না।”
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষের মধ্যেই যুদ্ধবিরতির কথা জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
অন্তরালের আলোচনায় ‘যুদ্ধবিরতি’ ও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা লঙ্ঘনের অভিযোগ
মিসাইল
তিনি আরও বলেন, “(যুক্তরাষ্ট্রের) পূর্ববর্তী অনেক প্রেসিডেন্ট একইভাবে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।”
বিবিসি ভেরিফাই আইন বিশেষজ্ঞদের কাছে জানতে চেয়েছে, মি. ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ কি মার্কিন সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল?
নাকি বােমা হামলার আগে তার কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল?
তবে, আর্টিকেল-২ এ বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, ফলে তিনি বিশেষ পরিস্থতিতে প্রয়ােজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
হোয়াইট হাউসের সূত্র বলছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই দ্বিতীয় ধারার ভিত্তিতেই ইরানে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।
দেশটির সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারেন।
যদিও সংবিধানে সেসব পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে বলা হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যায় বলা হয়, যদি বাস্তব বা সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা থাকে, কিংবা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হয়, তবে প্রেসিডেন্ট এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন।
ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ঠেকানোই ছিল ইরানে হামলার মূল কারণ, যা তারা জাতীয় স্বার্থ হিসেবে দেখেছে।
বিবিসি ভেরিফাই-এর সঙ্গে কথা বলা চারজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন যে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের কিছুটা আইনি অধিকার ছিল হামলার নির্দেশ দেওয়ার।
ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার অধ্যাপক ক্লেয়ার ফিনকেলস্টাইন বলেছেন, “সংক্ষেপে বললে, হ্যাঁ — এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের হাতে সে ক্ষমতা ছিল।”
তিনি আরও বলেন, অতীতে বহু প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই সীমিত সামরিক অভিযান চালিয়েছেন।
আরেকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, জেসিকা লেভিনসন মনে করেন, প্রেসিডেন্টের সীমিত পরিসরে বিমান হামলার অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা আছে, যতক্ষণ না তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নেয়।
তবে, বোডুইন কলেজের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু রুডালেভিজ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার মতে, যেহেতু এখানে হঠাৎ কোনো আক্রমণ প্রতিহত করার বিষয় ছিল না, তাই কােন দেশে হামলা চালানাের সেই আইনি অধিকার ট্রাম্পের ছিল না।
যদিও সংবিধানে কংগ্রেসকে যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে এটি খুব কমই ব্যবহার হয়েছে।
শেষবার কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ১৯৪২ সালে, যখন জাপান পার্ল হারবারে হামলা করেছিল।
এর আগে ১৮১২ সাল থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে কেবলমাত্র ১০ বার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্টদের কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই সামরিক অভিযান চালানো অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়কালে হোয়াইট হাউসের আইন উপদেষ্টা জন বেলিঞ্জার বলেন, গত কয়েক দশকে কংগ্রেস বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টদের সামরিক পদক্ষেপ কার্যত মেনে নিয়েছে।
রক্ষণশীল সংবিধান বিশেষজ্ঞ জনাথন টারলি বলেন, “কংগ্রেস ও আদালত কার্যত যুদ্ধ ঘোষণার শর্তকে অকার্যকর করে ফেলেছে।”
পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টরা কী করেছিলেন?
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কংগ্রেসের অনুমতি না নিয়েই লিবিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তার প্রশাসন এই পদক্ষেপকে সংবিধানের আর্টিকেল-২ এর আওতায় বৈধতা দেয়।
একই ধারা অনুসরণ করে তিনি ২০১১ সালে পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার মিশন চালানাের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালেও তিনি কংগ্রেসকে না জানিয়ে ইরানের সামরিক কর্মকর্তা কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দেন।
এর আগে, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯০-এর দশকে বলকান অঞ্চলে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া হামলা চালিয়েছিলেন।
একইভাবে, সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইয়েমেন ও সিরিয়ায় হুথি বিদ্রোহীদের উপর হামলা চালিয়েছেন কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই।
রক্ষণশীল সংবিধান বিশেষজ্ঞ জনাথন টারলি বলেন, “আমাদের ইতিহাসে প্রেসিডেন্টরা বারবার এ ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। ইতিহাস ও পূর্বসুরিদের করা নেয়া পদক্ষেপের উদাহরণ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে।”
হাউস স্পিকার মাইক জনসন আবার মি. ট্রাম্পের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলছেন, “উভয় দলীয় সাবেক প্রেসিডেন্টরা আর্টিকেল-২ অনুযায়ী সেনাপ্রধান হিসেবে একইভাবে পদক্ষেপ নিয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “প্রেসিডেন্ট ওবামা লিবিয়ায় সরকার পতনের উদ্দেশ্যে আট মাস ধরে বিমান হামলা চালান। তখন কোনো ডেমোক্র্যাটকে আপত্তি করতে দেখিনি। অথচ এখন সবাই চেঁচামেচি করছে।”
অন্য কী কী আইন রয়েছে?
ট্রাম্পের ইরানে হামলার সমালোচকরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের কথা তুলে ধরেছেন, যার নাম ‘ওয়ার পাওয়ার্স রেজোলিউশন’।
এটি ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র্রের বিপর্যয়ের পর পাশ হয়।
এ আইনের উদ্দেশ্য ছিল, কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া প্রেসিডেন্ট যেন সহজে যুদ্ধ চালাতে না পারেন, সেটি নিয়ন্ত্রণ করা।
এ আইন অনুযায়ী, জরুরি পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারেন ঠিকই, তবে তাতে বলা আছে, “যতটা সম্ভব, যুদ্ধ বা সংঘর্ষে যুক্ত হওয়ার আগে প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।”
জন বেলিঞ্জার বলেন, “ট্রাম্প সম্ভবত এই শর্ত মানেননি।”
এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প প্রকৃত অর্থে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো অর্থবহ আলোচনা না করে কেবল কিছু রিপাবলিকান নেতাকে ঘটনাটি জানিয়েছেন।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যম জানায়, ডেমোক্র্যাট সিনেট সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমারকে হামলার এক ঘণ্টা আগে ফোন করা হয়েছিল, তবে তাকে খুব বেশি তথ্য দেওয়া হয়নি।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট এক্স-এ লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট প্রশাসন “দলীয় সীমা অতিক্রম করে সৌজন্যমূলকভাবে কংগ্রেস নেতাদের ফোন করেছিল” এবং হামলার আগে সিনেটর শুমারের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছিল।
এই রেজোলিউশনে আরও বলা আছে, সামরিক অভিযান চালানোর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কংগ্রেসকে জানাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেন, “ইরানে হামলার পর বিমানগুলো নিরাপদে ফিরে আসার পর কংগ্রেসকে জানানো হয়েছে” এবং “ওয়ার পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী সব নিয়ম মেনে চলা হয়েছে।”