৪ঠা আগস্ট ড. ইউনূসকে নতুন সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়

গত বছরের ৪ঠা আগস্ট পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমরা নতুন সরকার গঠনের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করি। একইসঙ্গে তাকে নতুন সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব দেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের বিচারিক প্যানেলে ৪৭তম সাক্ষী হিসেবে নাহিদ এ জবানবন্দি দেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। সাক্ষ্যের জবানবন্দি দেয়ার পরে নাহিদকে জেরা করেন আসামিপক্ষের রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমীর হোসেন। তবে এদিন পুরোপুরি জেরা শেষ না হওয়ায়, মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী রোববার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম বলেন, গত বছরের ১৯শে জুলাই বিকালে সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে আমার কথা হয়। আমাদের পরামর্শ মতো সে ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন বিকালে আমি নন্দীপাড়া আমার এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেই। পরবর্তীতে হাসনাত ও সারজিসের সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন তারা ডিজিএফআইয়ের হেফাজতে ছিল যা আমি জানতাম না। আমি অন্যান্য সমন্বয়ক ও ছাত্র নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ২০শে জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই। সকল মিডিয়াতে এই ঘোষণাটি পাঠালেও কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া তা প্রচার করেনি। সেদিন রাত আনুমানিক ২.৩০ মিনিটে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি আমাকে হাতে হ্যান্ডকাফ, চোখে কালো কাপড় বেঁধে আটক করে একটি প্রাইভেট কারে করে তুলে নিয়ে যায়। পরে আমি জানতে পারি- তারা ডিবি পুলিশ পরিচয় দিলেও আসলে তারা ডিজিএফআইয়ের লোক ছিল।
আনুমানিক ২৪ ঘণ্টা পর রাতের বেলা আমাকে পূর্বাচল এলাকায় একটি ব্রিজের পাশে চোখবাঁধা অবস্থায় রেখে চলে যায়। সেখান থেকে আমি আমার বনশ্রীর বাসায় যাই। পরে আমি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে প্রেস ব্রিফিং করে আমাকে গুম ও নির্যাতনের কথা প্রকাশ করি।
আন্দোলন বন্ধে ডিজিএফআইয়ের তৎপরতা: জবানবন্দিতে তিনি বলেন, গত বছরের ২২শে জুলাই ডিজিএফআই অফিসার লে. কর্নেল সারোয়ার হাসপাতালে আমার রুমে জোরপূর্বক প্রবেশ করে আন্দোলন স্থগিত করার চাপ দেন। ২৩শে জুলাই ডিজিএফআই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আমাকে জোরপূর্বক হাসপাতাল থেকে সেখানে নিয়ে আন্দোলন সমাপ্তির ঘোষণা দেয়ার চাপ দিলেও আমি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেই। ডিজিএফআইয়ের কথামতো সংবাদ সম্মেলনে কথা না বলায় তারা আমাকে পুনরায় গুম করার হুমকি দেয়।
আন্দোলন বন্ধে ডিবিপ্রধান হারুনের চাপ: নাহিদ ইসলাম বলেন, ২৬ই জুলাই দুপুরে ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি হাসপাতালে এসে আসিফ, বাকের ও আমাকে একটি মাইক্রোতে করে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে ডিবিপ্রধান হারুন আমাদেরকে আন্দোলন স্থগিত করতে বলে, অন্যথায় আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের হুমকি দেয়। আমরা প্রথমে রাজি হইনি। পরদিন সমন্বয়ক হাসনাত ও সারজিসকে ডিবি অফিসে তুলে আনা হয়। পরবর্তীতে সমন্বয়ক নুসরাতকেও ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমাকে ওষুধ সরবরাহ করা হয়নি। একপর্যায়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য তাদের লিখিত একটি বক্তব্য আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক পাঠ করিয়ে তা ভিডিও করে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। ডিবির হারুন আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি আমরা প্রত্যাখ্যান করি এবং আমরণ অনশন শুরু করি। প্রায় ৩০ ঘণ্টার অধিক সময় ডিবি অফিসে অনশনে ছিলাম। অসুস্থ অবস্থায় ১লা আগস্ট আমাদেরকে ডিবি অফিস থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেদিন প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমরা ৬ জন সমন্বয়ক জানাই যে, জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
ছাত্রদলসহ কয়েকটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে একদফার ঘোষণা দেই: জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ডিবির অফিস থেকে বের হয়ে আমরা জানতে পারি, সমন্বয়ক মাহিন, রিফাত, কাদের, মাসুদরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ৩রা আগস্ট ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠন যেমন- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বামপন্থি কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে শহীদ মিনারে সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করি। একদফায় আমরা ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই। তখন সরকার পতনের একদফা দাবিতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করি।
জনতার গণভবন দখল: ৪ঠা আগস্ট শাহবাগে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করি। ওইদিন ৬ই আগস্ট “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচি ঘোষণা করি। সরকার কারফিউ ঘোষণা করে এবং দেশব্যাপী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। আমরা জানতে পারি যে, ৬ই তারিখের কর্মসূচি ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকার মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দিবে, আমাদেরকে হত্যা বা গুম করা হতে পারে। তাই আমরা আমাদের “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ই আগস্ট নির্ধারণ করি।
তিনি বলেন, এই কর্মসূচি সফলের লক্ষ্যে সমন্বয়কদের পক্ষে মাহফুজ আলম অন্যান্য ছাত্রসংঠন এবং নাগরিক সমাজের সাথে লিয়াজোঁ করেন। ৫ই আগস্ট সারা দেশের মানুষ ঢাকায় আসতে থাকে। আমরা শাহবাগে অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করি। শহীদ মিনার ও চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। সেনাবাহিনী একপর্যায়ে রাস্তা ছেড়ে দিলে আমরা শাহবাগে অবস্থান গ্রহণ করি। কিছুক্ষণের মধ্যে শাহবাগ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আমরা শুনতে পাই ঢাকার প্রবেশ মুখগুলো দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করছে। শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে আমরা গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পথিমধ্যে সংবাদ পাই যে, গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গেছে। আরও শুনতে পাই যে, ছাত্রজনতা গণভবনে প্রবেশ করেছে। সন্ধ্যায় আমরা সংবাদ সম্মেলন করে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের এবং সকল রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি জানাই। কোনো ধরনের সেনাশাসন বা সেনাসমর্থিত শাসন মেনে নিবো না বলে ঘোষণা দেই। যেহেতু শেখ হাসিনা সরকার প্রধান ছিলেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন সেহেতু তাদের নির্দেশেই হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও নিরঙ্কুশ করতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম।