বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের আর্বতে ভারত ও ইসলামী রাজনীতি

শেয়ার করুন

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ গভীর অস্থিরতার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, বিদেশি প্রভাবের বাড়াবাড়ি, আর জনগণের আস্থাহীনতা-সব মিলিয়ে দেশ এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। এর মধ্যে ভারতের ভূমিকাই সবচেয়ে আলোচিত, কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব শুধু কূটনীতি নয়, এখন সরাসরি নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতর পর্যন্ত বিস্তৃত।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে দলটি ক্ষমতা হারানোর পর ভারতের রাজনৈতিক বলয়ে সাময়িক ভাটা এলেও, খুব দ্রুত ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও মধ্যবর্তী শক্তিগুলোকে নিজেদের প্রভাবে নিয়ে নেয়। এই প্রক্রিয়ায় কিছু প্রাক্তন মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মধ্যস্ততাকারী ভারতের সহযোগিতায় রাজনৈতিক পুনর্বাসনের আশায় কাজ করছে।

অন্যদিকে, বিএনপি যারা এই মূহুর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল তারা নিজস্ব সংকটে জর্জরিত। দলের চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ, আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় দলটির ভেতরে একটি বিপথগামী গোষ্ঠী মিথ্যা মামলা ও ব্যক্তিগত প্রতিশোধের রাজনীতি চালিয়ে দলটির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে বিএনপিকে এখন শুধু সরকারের বিরোধী শক্তি নয়, বরং নিজস্ব বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের দলীয় যাত্রা শুরু করতে হচ্ছে।

এই অবস্থায় বিএনপির সামনে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে-একদিকে দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্র, যারা চায় না দলটি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরুক; অন্যদিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও নীতি-দিকনির্দেশনা।
কারণ বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে, তাদের নীতি তুলনামূলক স্বতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক হবে-যা ভারতের ভূরাজনৈতিক কৌশলের বিপরীতে দাঁড়াবে।

এখন বিএনপির জন্য প্রয়োজন একটি নতুন পররাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দর্শন-যেখানে থাকবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি উন্মুক্ততা, এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রকৃত প্রতিশ্রুতি। এমন একটি দর্শনই দলটিকে ভবিষ্যতের জন্য গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী বিকল্প শক্তিতে রূপ দিতে পারে।

জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতেও এক ধরনের কৌশলগত রূপান্তর দেখা যাচ্ছে। যারা একসময় ভারতের ঘোরবিরোধী ছিল, তারা এখন মন্দিরে গিয়ে পূজায় অংশ নিচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন জয় করতে গান–সংস্কৃতির আশ্রয় নিচ্ছে। তারা বলছে, “পূজা ও রোজা একই মুদ্রার দুই পিঠ।” এটি নিছক ধর্মীয় সহনশীলতার প্রকাশ নয়-বরং রাজনৈতিক কৌশল। এই অবস্থান ভারতের কাছে এক ধরনের সংকেত-“আমরাও মধ্যপন্থী, ভয় নেই।”

কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা কৌশল বলে, দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী বা জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান মানেই সম্ভাব্য হুমকি। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

বিশ্ব রাজনীতির সাম্প্রতিক উদাহরণগুলোও এ সত্য প্রমাণ করে- মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড, পাকিস্তানে ইমরান খান, বা আফগানিস্তানে তালেবান-সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক বা জনপ্রিয় সরকার হঠাৎই বিদেশি বা সামরিক হস্তক্ষেপে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশও এখন সেই ঝুঁকির মধ্য দিয়ে হাঁটছে।

যদি ইসলামী বা জাতীয়তাবাদী কোনো শক্তি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে, ভারত সেটিকে “নিরাপত্তা হুমকি” হিসেবে ব্যাখ্যা করবে। তখন কোনো অজুহাতে ভারতের রাজনৈতিক বা সামরিক প্রভাব পুনরায় প্রবল হয়ে উঠবে। আর আওয়ামী লীগ বলবে-“আমরাই তো উগ্রবাদ দমন করতাম এ কারনেই ।”

এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের জন্যও নতুন সুযোগ তৈরি হবে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব পুনর্গঠনের। তবে বাংলাদেশের সংকটের মূল কারণ একটাই রাষ্ট্রের ওপর দলের প্রভাব, নীতির ওপর ব্যক্তির আধিপত্য, এবং গণতন্ত্রের ওপর ভয়ের রাজনীতি। এই তিনটি বিষয় দূর না হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র কখনোই পরিপূর্ণ হবে না।

এখন সময় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর। রাষ্ট্রের স্বার্থকে দলের স্বার্থের উপরে রাখতে হবে। দেশকে যদি ভারতীয় আধিপত্য, বৈদেশিক প্রভাব বা সামরিক আগ্রাসনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে রাজনীতিতে নৈতিকতা ও নীতির পুনর্জাগরণ জরুরি।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা কি নিজেদের রাজনীতি নিজেরাই চালাতে পারব,
নাকি বাইরের শক্তির ছত্রছায়া বেঁচে থাকার পথ বেছে নেব। ইতিহাস কিন্তু বারবার একই শিক্ষা দিয়েছে-যে জাতি নিজের পথ নিজে নির্ধারণ করতে পারে না, তার জন্য পথ নির্ধারণ করে দেয় অন্য কেউ।

লেখক: হাফিজ আল আসাদ , বিশ্লেষক ও সমাজ ভিক্তিক উন্নয়ন পরামর্শক সাবেক সিনিয়র কনসালটেন্ট, এমডিসি বাংলাদেশ ডিরেক্টর আর্থ ফাউন্ডেশন।


শেয়ার করুন

Similar Posts