পুলিশের বেধড়ক পিটুনির পর কর্মবিরতিতে শিক্ষকরা
বেতনের গ্রেড বৃদ্ধি করাসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ওপর চড়াও হলো পুলিশ। কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান নিয়ে পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালায়। সড়কে পড়ে ছিল অনেকের ভাঙা চশমা ও কলম। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে
তিন দফা দাবিতে রাজধানীতে টানা অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে এসে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান ও বেধড়ক পিটুনির শিকার হয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গতকাল শনিবার শাহবাগে শিক্ষকদের পদযাত্রা কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা করে। এ সময় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেডে দেড় শতাধিক শিক্ষক আহত হন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ রোববার থেকে সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান ও আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন তারা।
শনিবার সন্ধ্যায় এ ঘোষণা দেন প্রাথমিক শিক্ষক দশম গ্রেড দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি শামসুদ্দিন মাসুদ। তিনি বলেন, দশম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি বাস্তবায়ন ও শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রোববার থেকে সারাদেশে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি চলবে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গতকাল রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হন। তারা সেখানে দুপুর পর্যন্ত সমাবেশ করেন। পরে বিকেলে কলম সমর্পণ কর্মসূচি পালন করতে শাহবাগে গিয়ে পুলিশি মারধরের শিকার হন। শিক্ষকদের ওপর নির্বাচারে লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং জলকামান থেকে পানি ছিটিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় শতাধিক শিক্ষক। তাদের অধিকাংশই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার পোড়াদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে এক শিক্ষক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছয় শিক্ষককে থানায় নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। রাত ১২টা ১ মিনিটে আটক শিক্ষকদের মুক্তি, আহতদের সুচিকিৎসা এবং পুলিশি হামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা।
শিক্ষকদের অভিযোগ, তারা সকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছিলেন। বিকেলে কলম সমর্পণ কর্মসূচি পালনের জন্য শাহবাগ আসার পথে শাহবাগ থানার সামনে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিনা উস্কানিতে পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
তবে পুলিশের দাবি, আন্দোলনকারী শিক্ষকরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগ মোড় পার হয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভবন যমুনার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এতে কয়েক পুলিশ সদস্য আহত হন। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিকেল ৩টার দিকে শহীদ মিনার থেকে তিন হাজারের বেশি শিক্ষক শাহবাগ মোড়ের দিকে রওনা হন। এই খবরে পুলিশ শাহবাগ থানার সামনে লোহার ব্যারিকেড দেয়। আন্দোলনকারীরা সেখান পৌঁছলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন তিনি।
তবে নেতারা বলেন, তাদের ২০ জনের প্রতিনিধি দল শাহবাগ মোড়ে কলম সমর্পণ কর্মসূচি পালন করে ফিরে যাবেন। এতে পুলিশ রাজি হলে শিক্ষকদের শহীদ মিনারে ফিরে যাওয়ার জন্য এক নেতা মাইকে ঘোষণা করেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের একটি দল ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগ মোড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। তখন পুলিশ লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের পাশাপাশি জলকামান থেকে পানি ছোড়ে। এতে দেড় শতাধিক শিক্ষক এবং ইটপাটকেলে আহত হন পুলিশের ১০ সদস্য।
শনিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া শাখা থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের একটি দল বিকেল ৩টায় কলম সমর্পণের নামে শাহবাগ থানার সামনে জড়ো হন। ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগ মোড় পার হয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এতে বেশ কয়েক পুলিশ সদস্য আহত হন।
রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মাসুদ আলম বলেন, শিক্ষকদের একটা পক্ষ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগের দিকে রওনা হয়। তখন তাদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিন্ন ভিন্ন দাবিতে ঢাকার রাজপথে আন্দোলনের সংখ্যা বেড়েছে। বেশ কিছু আন্দোলনে বিভিন্ন সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশকে নানাভাবে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে। কিন্তু গতকালের ঘটনায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে আহতের সংখ্যা অনেক বেশি। সাউন্ড গ্রেনেডে আহত হয়েছেন অনেকে। এ ছাড়া শিক্ষকরা দৌড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় রাস্তায় পড়ে ও পদদলিত হয়েও আহত হন।
আহতের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে দায়িত্বশীল এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ফাঁকা স্থানে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু গতকালের ঘটনায় পুলিশের কোনো সদস্য আন্দোলনকারীদের ভিড়ের মধ্যে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছেন। এ কারণে আহতের সংখ্যা বেড়েছে। যে পুলিশ সদস্যরা এই কাজটি করেছেন, তাদের এ ধরনের ঘটনায় কৌশল জানার ঘাটতি থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।
সাউন্ড গ্রেনেডে আহত একজন শিক্ষক বলেন, আমার পাশে এসে সাউন্ড গ্রেনেড পড়ে। পায়ে আঘাত লেগেছে। পুলিশ বিনা কারণে হামলা করেছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সেখানে পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু ব্যারিকেড ভেঙে আন্দোলনকারীরা পুলিশের ওপর হামলা করেছে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
শহীদ মিনারে সমাবেশ
এর আগে সকাল ৯টা থেকে শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সারাদেশ থেকে এসে জড়ো হতে শুরু করেন। সকাল ১০টায় শুরু হয় সমাবেশ। সমাবেশে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শিক্ষক প্রতিনিধিরা বক্তৃতা করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৯। এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা তিন লাখ ৮৪ হাজারের বেশি। আর শিক্ষার্থী প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ জন।
আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষা সামনে রেখে শিক্ষকদের আন্দোলন ও কর্মবিরতিতে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা।
এক বিবৃতিতে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম জানিয়েছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৃতীয় প্রান্তিক শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের মাত্র ৬০-৬৫ শতাংশ পড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে অগ্রগতি আরও কম– শুধু ৫০-৫৫ শতাংশ। হাতে রয়েছে মাত্র ২০-২৩টি কর্মদিবস, যা নির্ধারিত সিলেবাস সম্পন্নে চরম চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
সহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবি হলো– দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড সমস্যার সমাধান এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি বাস্তবায়ন।
গত ২৪ এপ্রিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১১তম থেকে দশম গ্রেডে এবং ১৩তম গ্রেডে থাকা শিক্ষকদের বেতন ১২তম গ্রেডে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নন সহকারী শিক্ষকরা।
প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, নার্স, কৃষি কর্মকর্তা, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, এমনকি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা স্নাতক ডিগ্রি নিয়েই দশম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। অথচ আমরা স্নাতক ডিগ্রির পাশাপাশি সিএনএড, বিপিএড ও বিটিপিটি কোর্স সম্পন্ন করেও ১৩তম গ্রেডে রয়েছি। এটি বৈষম্য। তাই ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছি।
অন্যদিকে, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের আরেক অংশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের ব্যানারে একাদশ গ্রেডে বেতন, উচ্চতর গ্রেডের জটিলতা নিরসন ও শতভাগ পদোন্নতির দাবিতে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারকে সময়সীমা দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি না মানা হলে ২৩ ও ২৪ নভেম্বর অর্ধদিবস কর্মবিরতি, ২৫ ও ২৬ নভেম্বর পূর্ণদিবস কর্মবিরতি এবং ২৭ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
শিক্ষকদের দশম গ্রেডে আনার যুক্তি নেই, বললেন উপদেষ্টা
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার গতকাল খুলনায় মতবিনিময় সভা শেষে বলেছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদটি ১৩তম গ্রেডের। এটিকে এক লাফে দশম গ্রেডে আনার সপক্ষে তেমন কোনো যুক্তিই নেই।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ সহকারী শিক্ষক মনে করেন দশম গ্রেডের এ দাবি যৌক্তিক নয়। প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে তাদের দশম গ্রেডে আনা; এটি সম্ভব নয়। তারা যেন ১১তম গ্রেড পেতে পারেন, সেজন্য আমরা কাজ করছি। তাদের এ মুহূর্তে আন্দোলনে যাওয়াটাও যৌক্তিক নয়।
উপদেষ্টা বলেন, সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির যে বিষয়টি, সেটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলেছে সরকারের নীতি অনুযায়ী শতভাগ পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। আমরা সেজন্য ৮০ শতাংশ পদোন্নতি দিয়েছি। আগে ছিল ৬৫ শতাংশ। বাকি যে ২০ শতাংশ থাকছে, সেটা সরাসরি নিয়োগ করা হবে।
