মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা : শেখ হাসিনার রায়ের দিনক্ষণ ঠিক হবে আজ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ের তারিখ আজ বৃহস্পতিবার ঘোষণার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। উভয় পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২৩ অক্টোবর এই দিন ধার্য করে আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
রায়ের তারিখ ঘোষণা উপলক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। সকাল থেকে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি, র্যাব ও আনসার বাহিনী মোতায়েন থাকবে। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কয়েক স্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সেনা মোতায়েন চেয়ে সেনা সদরদপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আজ বৃহস্পতিবার ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি নিয়েছে। এ কর্মসূচির কারণে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গত কয়েকদিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ককটেলের বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ বলছে, এসব ঘটনার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এদিকে নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, সব ধরনের অপতৎপরতা ঠেকাতে আইনে যে ক্ষমতা আছে তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হবে।
জুলাই গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি। ইতোমধ্যে মামুন অপরাধের দায় স্বীকার করে ‘রাজসাক্ষী’ হয়েছেন। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর আদালত অবমাননার দায়ে গত ২ জুলাই এই ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের সাজার আদেশ দেন।
‘বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা’
রায়ের তারিখ ঘোষণা ঘিরে সহিংসতা নিয়ে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অংশ হিসেবে দেশজুড়ে নৈরাজ্যের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তবে এটিকে থ্রেট টু জাস্টিস মনে করি না। বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তারা এমনটা করছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালের চলমান বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, আইনানুগভাবে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করেন।
ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা হচ্ছে না বলে জাতিসংঘে দেওয়া আওয়ামী লীগের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিজানুল ইসলাম জানান, বিষয়টি তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম কী হচ্ছে, সেটা যদি ধরাতে হয় তাহলে আসামিকে উপস্থিত হতে হবে। উপস্থিত হয়ে আবেদন করে বলতে হবে, কোথায় অনিয়ম হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘শুধু স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী ছাড়া পলাতক আসামিদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তির কথা বলার সুযোগ নেই। আর শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিযুক্ত করা হয় আমির হোসেনকে। তিনি শেখ হাসিনার আমলে কোনো একটা কোর্টের স্পেশাল পিপির দায়িত্বে ছিলেন বলে জেনেছি। অর্থাৎ তিনি তাঁরই লোক। কাজেই এখানে ভিন্ন কোনো সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কারণ নেই। স্টেট ডিফেন্সের কোনো অযোগ্যতা নেই। এর পরও যদি আইনজীবীর ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তাহলে যিনি প্রশ্ন উত্থাপন করবেন, তাঁকে এ মামলায় কথা বলার অধিকার থাকতে হবে। পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে আসতে হবে। আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। অথবা আইনজীবী নিয়োগ ছাড়া নিজেরাই বক্তব্য দেওয়ার অধিকার রাখেন তারা। হাজির হয়ে তারা কথা বলুন। বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশি কোনো গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষমতা তাদের নেই।
জাতীয় ঈদগাহে বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের দিন সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ও এর আশপাশের সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় জাতীয় ঈদগাহ মাঠে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। রোববার সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন শাখা থেকে বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট কম্পাউন্ড, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ভবন ও তৎসংলগ্ন এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, সুপ্রিম কোর্ট ও বিশেষ কোর্টের নিরাপত্তা বিভাগ, শাহবাগ থানার ওসি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, গত ১১ দিনে ১৫টি জায়গায় ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গত দুই দিনে ৯টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
প্রেক্ষাপট
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৪০০ নিরীহ মানুষকে হত্যা ও ২৫,০০০ মানুষের অঙ্গহানির উস্কানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটিসহ পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর গত বছর ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রসিকিউশন বাদী হয়ে মামলা করে। এরপর গত বছর ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১ জুন প্রসিকিউশনের দেওয়া শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। এ মামলায় ৮৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
