চট্টগ্রাম-কুমিল্লার বিএনপিতে বাস্তবতা, ত্যাগ এবং সুবিধাবাদ
বিগত প্রায় দুই দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি এক অদ্ভুত সংকটচক্রের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছে। নির্বাচনী হিসাব–নিকাশ, প্রশাসনিক বাস্তবতা, তৃণমূলের ত্যাগ এবং কেন্দ্রের দ্বিধার মাঝে দলটি সম্ভবত নিজেকেই নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। মাঠের রাজনীতিতে যেখানে ত্যাগী নেতাকর্মীরা রক্ত, ঘাম, জীবন এবং পরিবার উজাড় করে দিয়েছে, সেখানে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ও কৌশলগত অদূরদর্শিতা দলীয় সংগঠনকে ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে।
চট্টগ্রাম এই বাস্তবতার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। সেখানে অধ্যাপক আসলাম চৌধুরী এক অসাধারণ রাজনৈতিক চরিত্র-যিনি নেতার অভিধায় সীমাবদ্ধ নন, বরং ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও সংগঠনী দৃঢ়তার জীবন্ত উত্তরাধিকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একমাত্র মানুষ হিসেবে তিনি টানা ৮ বছর ৬ মাস কারাবন্দী থেকেও প্রতিটি নেতাকর্মীর খোঁজ রেখেছেন; কারাগারের অন্ধকার থেকে তিনি তাদের হাতখরচ পাঠিয়েছেন, পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়েছেন, রাজনৈতিক মনোবল ধরে রেখেছেন। একই সময়ে তাঁর নিজের হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ধসে গেছে, পরিবার সংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছে , তাঁর একমাত্র কন্যা এসএসসি পরীক্ষার দিনে পিতার হাত ধরে পরীক্ষার হলে যাওয়ার কথা থাকলেও ঠিক সেই দিনই পিতা কারাগারে যায়, আর কন্যা একা একা পরীক্ষা দিতে যায়। তবু দল ও নেতাকর্মীর প্রতি তার অটল বিশ্বাস এতটুকু ভাঙেনি।
কারামুক্তির পর তিনি যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যবসা পুনর্গঠনে, কর্মচারীদের ধরে রাখতে, ব্যাংক দায় শোধ করতে এবং প্রতিদিন জন-মানুষের মাঝে জনসংযোগ করতে ব্যস্ত, তখনই ষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ তাঁর ব্যাপক জনসমর্থন, বিশাল প্রভাব এবং সংগঠনী সক্ষমতা তাদের অস্বস্তির কারণ। লন্ডন কার্যালয়ে পাঠানো কোন তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তে তাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করলো-তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু যে ব্যক্তি একই সময়ে চট্টগ্রাম ১০, বন্দর ও সীতাকুণ্ডে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালে পুরো চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে যেতে পারে-তাকে উপেক্ষা করা রাজনৈতিক ভুল বা কৌশলগত আত্মঘাত।
এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামে যেমন ষড়যন্ত্রের তীব্রতা বেড়েছে, ঠিক তেমনি কুমিল্লা হয়ে উঠেছে সুবিধাবাদী রাজনীতির নির্মম উদাহরণ। কুমিল্লা–৬ আসনের শাহ সেলিম—২০০৯ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে পরবর্তী ১৬ বছর নিরাপদ ব্যবসায় জীবন কাটিয়েছেন, কোন মামলা–হামলার মুখোমুখি হননি, কোন আন্দোলনে ছিলেন না। কিন্তু ৫ আগস্টের পর হঠাৎ করেই তিনি আবার বিএনপিতে ফিরে এলেন এবং প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরীর পাশে অবস্থান নিলেন। একই সময়ে তাঁর ছেলে নাভিদ নওরোজ শাহ একই আসন থেকে এনসিপির প্রার্থী। এক বাবা বিএনপির হয়ে ভোট চাইছেন, আর ছেলে এনসিপির হয়ে ভোট চাইছে-এ যেন সুবিধাবাদী রাজনীতির সর্বোচ্চ রূপ। যেখানে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ১৬ বছর মামলা, হামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন সয়ে দলকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেখানে সুবিধাবাদীদের জন্য জায়গা করে দেওয়া কি তৃণমূলের সঙ্গে নির্মম বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
এভাবে যখন মাঠে ত্যাগী কর্মীরা প্রহৃত হচ্ছে, জেল–জুলুম সহ্য করছে, তখন কিছু নেতার নীরবতা প্রশ্ন তোলে-এরা সত্যিই কার? ভোটের মাঠে কোথায় ছিল তারা এতদিন? প্রশাসনে তাঁদের যোগাযোগ কতটা বাস্তব? ২০০৮ সালের পাতানো নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে আজও ভাবা হচ্ছে-ড. ইউনুস নেতৃত্বাধীন কোন শক্তি হয়তো বিএনপির জন্য শুভ হবে। বাস্তবতা হলো-এই আশা রাজনৈতিক অজ্ঞতা এবং মানসিক সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ প্রশাসনের অনেক শক্তি আজও আওয়ামী লীগ, জামাত ও এনসিপি–ঘনিষ্ঠ আমলাতন্ত্রের হাতে। ভোট যাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে-তারা মাঠের বাস্তবতা চেনে, এবং তাদের প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
এইসব উদাহরণ দেখায়-বিএনপি এখনও কৌশল, সংগঠন ও নেতৃত্বের জায়গায় একটি কঠিন সঙ্কটে আছে। তৃণমূলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দলটি যদি সুবিধাবাদীদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে থাকে, এবং পরীক্ষিত, ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা করে যায়-তাহলে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হতে বাধ্য। বিএনপিকে অবশ্যই বুঝতে হবে-একজন আসলাম চৌধুরীর ত্যাগ, তার সংগ্রাম, তার রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং জনসমর্থন দলের জন্য কী অর্থ বহন করে। তেমনি কুমিল্লার উদাহরণও দেখিয়ে দেয় যে, সুবিধাবাদীদের উপর নির্ভর করা মানে ভবিষ্যৎ সংকটকে আমন্ত্রণ জানানো।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির সামনে কেবল একটি পথ-ত্যাগী নেতাকর্মীদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা, সুবিধাবাদী চক্রকে ছেঁটে ফেলা, বাস্তব প্রশাসনিক হিসাব–নিকাশ বোঝা এবং মাঠের মানুষের মনস্তত্ত্বকে গুরুত্ব দেওয়া। অন্যথায় যে রাজনৈতিক বিপর্যয় সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তা সামাল দেওয়ার শক্তি তখন দলের কারো কাছেই অবশিষ্ট থাকবে না।
লেখক: মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।
