বাংলাদেশ: ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপট ও অগ্রগতির সম্ভাবনা

শেয়ার করুন

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি ছিল বহুস্তরীয় জটিলতা, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, শাসনব্যবস্থার ঘাটতি এবং জনগণের প্রত্যাশা-বিচ্যুতির এক সম্মিলিত প্রতিফলন। ঘটনাটিকে শুধুমাত্র “বিপ্লব”, “গণঅভ্যুত্থান” বা “রাজনৈতিক প্রতিশোধ” হিসেবে বর্ণনা করলে পুরো বাস্তবতার চিত্র ফুটে ওঠে না; বরং এটি ছিল বহুবর্ষের রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক সংকট, প্রশাসনিক অনমনীয়তা এবং সামাজিক মনস্তত্ত্বের এক বিস্ফোরণ।

পরিস্থিতির উৎপত্তি ও কাঠামোগত কারণ:- ঘটনার মূল কারণগুলোকে তিনটি স্তরে ব্যাখ্যা করা যায়-
(১) রাজনৈতিক কাঠামোর সংকট
দীর্ঘদিনের এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পরিবেশের সংকোচন, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনআস্থার অবক্ষয় এবং প্রশাসন–দলীয় রাজনীতির অতিরিক্ত সমন্বয় জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার বিষয়ে বিতর্ক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে।

(২) অর্থনৈতিক চাপ ও বৈষম্য
মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, তরুণদের বেকারত্ব, আর্থিক খাতের অস্থিরতা এবং ব্যাপক দুর্নীতির অনুভূতি সাধারণ নাগরিকের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে তোলে। জনগণের দৈনন্দিন জীবনের চাপ রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিস্ফোরণাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করে।

(৩) সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণ
সময় দীর্ঘের দমন–অভিযোগ, তরুণদের হতাশা, ডিজিটাল যুগে দ্রুত তথ্য বিনিময় এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতা বিস্তার ঘটায়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক মেরুকরণ এতটাই দৃঢ় হয় যে একটি বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবর্তনের ইচ্ছা তীব্র আকার ধারণ করে।

দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা:

অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে, পরিস্থিতির সৃষ্টি ও তীব্রতার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের প্রশাসনিক ভুল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সীমিত করার প্রবণতা এবং জনগণের ক্ষোভ যথাসময়ে উপলব্ধি করতে না পারা বড় ভূমিকা রেখেছে। জনআস্থা পুনরুদ্ধার, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু এবং নীতিগত সংস্কার গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতি হয়তো সংঘর্ষের দিকে যেত না।

পরবর্তী পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রধানত আত্মরক্ষামূলক ও পুনর্গঠনমূলক ছিল। দলটি সংগঠন পুনর্গঠন, নীতি পুনর্বিবেচনা এবং রাজনৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থান পুনর্স্থাপনের চেষ্টায় মনোযোগী হয়। আওয়ামী লীগের ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব, আধুনিকতার অগ্রযাত্রা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রগতিশীল মূল্যবোধে অবদান—যা এখনও দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর কাছে রাজনৈতিক বৈধতা তৈরি করে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের সামনে বড় ঝুঁকি হলো সংগঠনের জনআস্থা সংকট, অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের চ্যালেঞ্জ, এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নতুন শক্তির উত্থান।

আওয়ামী লীগের বৃহৎ কর্মীবাহিনী: নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কৌশল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের বিপুল কর্মীবাহিনী দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশল হলো—এই বৃহৎ কর্মীবাহিনীর সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক নিরাপত্তা, কর্ম-নিরাপত্তা এবং জান–মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করা। কারণ—রাজনৈতিক প্রতিশোধের আশঙ্কা থেকে কর্মীবাহিনীকে বের করে আনতে না পারলে, সামগ্রিক জাতীয় ঐক্য অসম্ভব।
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় এই জনগোষ্ঠীকে বাদ দিলে দীর্ঘমেয়াদে সংঘাত ও অবিশ্বাস তৈরি হবে। তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে শত্রুতা নয়, রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের অংশ হিসেবে সম্মান দিলে নতুন ক্ষমতার প্রকল্প স্থায়ী হবে। এটি বিএনপির জাতীয় ঐকমতের রাজনীতির জন্য অত্যাবশ্যক।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিএনপি’র প্রয়োজনীয় কৌশল: বাংলাদেশে একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনে বিএনপির সামনে কয়েকটি বড় সুযোগ রয়েছে। তবে সেই সুযোগগুলো পুরোপুরি কাজে লাগাতে দলকে কিছু মৌলিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে—

১. সমগ্র জাতিকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ

রাজনৈতিক প্রতিশোধহীনতা ঘোষণা এবং বাস্তবে তা অনুসরণ। আওয়ামী লীগ, বাম, ডান ও ধর্মীয় দলসহ সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে “ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন ফোরাম” গঠন। ট্রানজিশনাল জাস্টিসে প্রতিশোধ নয়—ন্যায়, পুনর্গঠন ও পুনর্মিলনকে অগ্রাধিকার।

২. একটি আধুনিক রাষ্ট্রভিশন উপস্থাপন:
প্রযুক্তি-চালিত প্রশাসন
দুর্নীতি নির্মূলে ডিজিটাল ট্রান্সপারেন্সি
জ্বালানি, শিল্পনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে দীর্ঘমেয়াদি ব্লুপ্রিন্ট
নতুন রাজনৈতিক সামাজিক চুক্তি (Social Contract)

৩. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণে কাঠামোগত সংস্কার

স্বাধীন বিচারব্যবস্থা
নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
পুলিশ–প্রশাসনের পেশাদারীকরণ

৪. অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে রাজনৈতিক অগ্রাধিকার করা

বৈদেশিক বিনিয়োগ আস্থা পুনরুদ্ধার
তরুণদের জন্য স্কিল-ভিত্তিক অর্থনীতি
ব্যাংকিং সেক্টর সংস্কার
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

৫. রাজনৈতিক সহনশীলতার নতুন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা

বিরোধী মতাদর্শ সহ্য করার নতুন রাজনৈতিক কৌশল

সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রায়ন

গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা

এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে, জাতীয় ঐক্য এবং আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণে বিএনপি দেশের সকল অংশকে যুক্ত করতে পারবে।

উপসংহার

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনা ছিল দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সামাজিক ক্ষোভ ও অর্থনৈতিক চাপের একটি বিস্ফোরণ। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা-কোনো রাষ্ট্রেই অন্তর্ভুক্তিহীন শাসন ও একমুখী কর্তৃত্ব স্থায়ী হতে পারে না। আজ দেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে সকল দল, সকল মতবাদ, সকল শ্রেণি ও প্রতিটি নাগরিক নিজের জায়গা খুঁজে পাবে বিএনপির সামনে সুযোগ রয়েছে আধুনিক বাংলাদেশের জন্য নতুন রাজনৈতিক সামাজিক চুক্তির স্থপতি হওয়ার-যদি তারা প্রতিশোধ নয়, পুনর্গঠনকে অগ্রাধিকার দেয়; বিভাজন নয়, ঐক্যকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করে।

মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।


শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত