মির্জা আব্বাসকে ঘিরে অপপ্রচার, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সত্য-অসত্যের স্রোত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মির্জা আব্বাস এমন একটি নাম, যিনি দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে নেতৃত্ব, আন্দোলন, সংঘাত ও বিতর্ক-সব কিছুর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনকে প্রভাবিত করে আসছেন। তাঁর সমালোচক যেমন আছেন, তেমনি আছেন একনিষ্ঠ সমর্থকও। সাম্প্রতিক একটি ঘটনার পরে আবারও তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন-এবারও তাকে ঘিরে ওঠে নানা অভিযোগ, গুজব ও নেতিবাচক প্রচার।
মির্জা আব্বাসের রাজনৈতিক অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-৮০ দশক থেকেই তিনি ছাত্র ও নগর রাজনীতিতে সক্রিয়, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শীর্ষ নেতাদের একজন এবং ১৯৯১ সালে ঢাকা-৬ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচনেও জয়ী হন। একই বছর তিনি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র হিসেবে কাজ করেন। তাঁর ক্যারিয়ারের এই অংশটি ঢাকার রাজনীতিতে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রায় সমালোচনা যেমন হয়েছে, তেমনি তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের ইতিহাসও কম নয়। একাধিকবার গ্রেপ্তার, দীর্ঘ রিমান্ড, অসংখ্য মামলা-এসবই তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেই একটি নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে-যেকোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর দ্রুততার সঙ্গে প্রমাণের আগেই মির্জা আব্বাসকে দায়ী করার চেষ্টা। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই সামাজিক মাধ্যমে প্রস্তুত ফটোকার্ড, প্রচার ও নেতিবাচক ম্যাসেজ এই প্রবণতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা-বিশেষ করে ভোটের মাঠে-এক ধরনের কৌশল দাবি করে। কিন্তু যখন সেই কৌশল নেমে আসে অপপ্রচারে, তখন তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির কাঠামোকেই দুর্বল করে। প্রশ্ন উঠছে-যে ব্যক্তি সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো প্রতিষ্ঠিত নেতার বিরুদ্ধেও সুদীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক সংগ্রাম করে টিকে থাকতে পেরেছেন, তিনি কি সত্যিই নবীন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করার মতো রাজনীতির পথ বেছে নেবেন? এবং যে নবীন কর্মীর ভক্তদের কেউ কেউ বলছেন, তিনি মির্জা আব্বাসের ভোটের সামান্য অংশেও প্রভাব ফেলতে পারবেন না-তাহলে এই দ্রুত দায়ারোপের নেপথ্য উদ্দেশ্য কী?
এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট-রাজনীতির ময়দানে যাঁরা সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বী নন, তাঁদের কেউ কেউ মির্জা আব্বাসকে টার্গেট করে নিজেদের রাজনৈতিক সুফল আদায়ের চেষ্টা করছেন। এতে তাঁরা যেমন বিএনপির অভ্যন্তরে বিভাজন তৈরি করতে চান, তেমনি জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাকেও কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন। অপপ্রচার, চরিত্রহনন, নেতিবাচক লেবেলিং-এসবই সেই কৌশলের অংশ, যা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতিতে অদৃশ্যভাবে কাজ করে এসেছে।
অবশ্যই মির্জা আব্বাসের ভুল থাকতে পারে, তাঁর কর্মপদ্ধতি বা বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়-এটাই রাজনৈতিক স্বাভাবিকতা। কিন্তু তথ্য-যাচাই ছাড়াই অভিযোগ ছড়ানো, প্রোপাগান্ডার ছলে একজন দীর্ঘমেয়াদি নেতার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করার চেষ্টা-এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক সহনশীলতার জন্য ক্ষতিকর।
মির্জা আব্বাসের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকা-দুটোই মানুষের মতামতের স্বাধীনতা। কিন্তু কোনও ঘটনার পরপরই নির্দিষ্ট কিছু মহল যে গতিতে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়, তা দেখলে বোঝা যায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আজ অনেকটাই কৌশল ও প্রচারের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। আর সেই যুদ্ধেই বারবার ওঠে আসে একটি পুরোনো প্রশ্ন-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি সত্যিই পরিণত হচ্ছে, নাকি আগের মতোই দোষারোপ, বিভাজন ও অপপ্রচারই হয়ে উঠছে প্রধান হাতিয়ার?
যে প্রেক্ষাপটেই হোক, একটি বিষয় পরিষ্কার-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার এই ধারাটি যদি না বদলায়, তাহলে আগামী দিনে আরও বেশি নেতাই অপপ্রচারের শিকার হবেন। আর এর সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর, যেখানে ভিন্নমত, সহনশীলতা আর যুক্তির জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
লেখক : মো:হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলম লেখক ।
