বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, দায় অস্বীকারের রাজনীতি ও ‘নতুন স্বাধীনতা’র প্রশ্ন
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলোর একটি। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে পরিকল্পিতভাবে দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলীসহ শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল হঠাৎ কোনো প্রতিশোধমূলক ঘটনা নয়; ছিল সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগী আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী মিলে এই হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত করে-যার উদ্দেশ্য ছিল সদ্য জন্ম নিতে যাওয়া রাষ্ট্রটিকে মেধাশূন্য করা, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করা।
এই সত্যটি মুক্তিযুদ্ধ-গবেষণা, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রতিবেদন এবং বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছে, তালিকা তৈরি করেছে, অপহরণ ও নির্যাতনের অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। দেশীয় ঘাতকরা ছিল মূলত দোসর,পাকিস্তানি সামরিক শাসনের আদর্শিক ও সাংগঠনিক সহযোগী।
এই প্রেক্ষাপটে আজ যখন একটি মহল বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় ভারতের উপর চাপানোর চেষ্টা করে, তখন তা শুধু ইতিহাস বিকৃতি নয়, বরং শহীদদের স্মৃতির প্রতি চরম অবমাননা। ভারতের ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মিত্র শক্তি হিসেবে-ডিসেম্বরের শুরুতে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ তারই ধারাবাহিকতা। ভারতীয় বাহিনীর কোনো নথি, গবেষণা, আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন কিংবা নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদের বিশ্লেষণে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ নেই। বরং হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় ১৪ ডিসেম্বর, যখন পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় এখনো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এবং আল-বদর বাহিনী সক্রিয়ভাবে অপহরণ চালাচ্ছে। সুতরাং ভারতের উপর দায় চাপানো একটি রাজনৈতিক সুবিধাবাদী প্রচারণা ( narrative) যার উদ্দেশ্য একাত্তরের ঘাতকদের দায় হালকা করা এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অপরাধকে ধুয়ে-মুছে সাফ করা।
এবারের বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসটি সত্যিই কি অন্যরকম গেল? রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে আগের মতো আড়ম্বর, দৃঢ়তা ও নৈতিক স্পষ্টতা কি দেখা গেছে? প্রশ্নটি অস্বস্তিকর হলেও জরুরি। যখন একই সময়ে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য শোনা যায় যেখানে জামায়াত নেতারা নির্দ্বিধায় পাকিস্তানি বাহিনীকে দায়মুক্তি দেন, নিজেদের ভূমিকা নিয়ে কোনো অনুতাপ তো দূরের কথা, বরং ইতিহাস পুনর্লিখনের স্পর্ধা দেখান-তখন রাষ্ট্রের নীরবতা অনেক কিছু বলে দেয়। দায় স্বীকার না করা শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়; এটি এক ধরনের আদর্শিক অবস্থান, যেখানে ঘাতক নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেই শহীদের রক্ত অস্বীকার করে।
আরও উদ্বেগজনক হলো-দেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু কর্তা ব্যক্তির ভূমিকা। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাজাকারদের ছবি মুছে দেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রকাশ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে দায়মুক্তি দেন। এরা কেবল প্রশাসক নন, জাতির বিবেক গঠনের দায়িত্বে থাকা মানুষ। যখন শিক্ষার সর্বোচ্চ মঞ্চ থেকে ইতিহাস বিকৃতি ছড়ানো হয়, তখন সেটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনার উপর সরাসরি আঘাত।
এই বাস্তবতার মধ্যেই বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে ডিবি কর্তৃক জিম থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা একটি ভয়ানক প্রতীক হয়ে ওঠে। বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস মানে তো কেবল ফুল দেওয়া নয়; মানে চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নকে নতুন করে স্মরণ করা। অথচ সেই দিনই একজন সাংবাদিককে তুলে নেওয়া হয়। আজ জিম থেকে, কাল স্ত্রীর শয্যা থেকে, পরশু অসুস্থ মায়ের পাশে থেকে কিংবা সন্তানের স্কুল বা খেলার মাঠ থেকে—এই ধারাবাহিকতা কি ইতিহাসে আমরা দেখিনি? ১৯৭১-এর ডিসেম্বরেও তো এমনভাবেই মানুষ তুলে নেওয়া হয়েছিল।
তাহলে আমরা যে ‘নতুন স্বাধীনতা’র কথা শুনেছিলাম, সেটি কি কেবল স্লোগান? বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণ যদি রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে, অথচ একই সাথে মতপ্রকাশ দমন, ইতিহাস বিকৃতি ও ঘাতকদের পুনর্বাসন চলতে থাকে-তবে সেই স্মরণ অর্থহীন হয়ে পড়ে।
আবেগহীন ইতিহাসের নিরিখে সত্য একটাই: বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের পরিকল্পিত অপরাধ, যার বাস্তবায়নে দেশীয় সহযোগীরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। এই দায় থেকে পাকিস্তান বা তাদের আদর্শিক উত্তরসূরিদের মুক্ত করার কোনো ঐতিহাসিক বা নৈতিক ভিত্তি নেই। ভারতের উপর দায় চাপানো একটি রাজনৈতিক মিথ, যা প্রমাণ দিয়ে নয়, প্রচারণা দিয়ে টিকে থাকতে চায়।
ইতিহাস প্রতিশোধ চায় না, চায় স্বীকৃতি। দায় স্বীকার ছাড়া কোনো জাতি সত্যিকারের সামনে এগোতে পারে না। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের সেই কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়-আমরা কি ইতিহাসের পক্ষে দাঁড়াব, নাকি সুবিধার পক্ষে?
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে গ্রন্থসূত্র (রেফারেন্স):
১. মুনতাসীর মামুন -বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ১৯৭১
২. রফিকুল ইসলাম – একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা
৩. আহমদ শরীফ – একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা
৪. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.) – বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (বিশেষত ১০ম-১৪তম খণ্ড)
৫. সেলিনা হোসেন – হাঙর নদী গ্রেনেড (প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট)
৬. অ্যান্থনি মাসকারেনহাস – The Rape of Bangladesh
৭. সুমিত সরকার – 1971: Documents and Essays
৮. রিচার্ড সিসন ও লিও রোজ -War and Secession: Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh
৯. বদরুদ্দীন উমর – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যা
১০. মঈদুল হাসান -মূলধারা ’৭১
এই গ্রন্থগুলো একত্রে একটি সুস্পষ্ট সত্য প্রতিষ্ঠা করে-বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের, অন্য কারও নয়।
হাফিজ আল আসাদ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলাম লেখক। গবেষক ও প্রচার সম্পাদক ইতিহাস এলামনাই এসোসিয়েশন (CUHDA)
