তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন, রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা বিশ্লেষণ (প্রথম পর্ব)
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায় ১৮ বছর পর দেশে ফিরছেন। আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশের মাটিতে পা রাখবেন তিনি। তারেক রহমানের দীর্ঘ সময় পর প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার ফেরার মধ্যে দিয়ে দেশবিদেশের রাজনীতির ময়দানের নানা হিসেবে নিকেশ চলছে। এটি শুধু কোনো একটি দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রের সামগ্রিক রাজনৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক ভারসাম্য, নির্বাচন ব্যবস্থা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত একটি প্রক্রিয়া। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করা একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা দেশে ফিরলে সেই প্রত্যাবর্তন রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় কীভাবে প্রতিফলিত হবে, সেটিই এখন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে আবেগ বা অনুমানের জায়গা থেকে নয়, বরং তথ্য, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকারের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর জনগণের আস্থা ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে-এমন ধারণা সমাজের বিভিন্ন স্তরে দৃশ্যমান। বিরোধী রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে সাংগঠনিক ও কার্যকর শক্তি হিসেবে মাঠে দৃশ্যমান হতে পারেনি, আবার ক্ষমতাসীন রাজনীতির ক্ষেত্রেও বিরোধী শক্তিকে দমনের অভিযোগ জনপরিসরে প্রতিষ্ঠিত। এই বাস্তবতায় একটি শক্তিশালী ও সংগঠিত রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি এমন এক রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার বহন করেন, যার সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীর্ঘ ইতিহাস জড়িত। জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রগঠনের দর্শন এবং বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতায় তারেক রহমান একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে রাজনীতিতে উপস্থিত। দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করলেও তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় নীতিনির্ধারণ ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় সক্রিয় ছিলেন। ফলে তাঁর প্রত্যাবর্তনকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কোনো অধ্যায় হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
তারেক রহমানের ইতিবাচক দিকগুলোর একটি হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সংঘাত ও প্রতিহিংসার ভাষার পরিবর্তে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা পরিবর্তন, রাজনৈতিক সংস্কার এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে সহিংসতা ও শূন্য-সম প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করেছে, সেখানে এই ধরনের অবস্থান একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে। তাঁর প্রত্যাবর্তন যদি এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মাঠপর্যায়ে বাস্তব রূপ দিতে পারে, তাহলে তা রাজনীতির আচরণগত পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন একটি পরীক্ষাও বটে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বড় নেতাদের আগমন প্রায়ই উত্তেজনা ও অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। তবে এই বাস্তবতা অস্বীকার করেও বলা যায়, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাইলে এই উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রিত ও শান্তিপূর্ণ ধারায় পরিচালিত করতে পারে। তারেক রহমান যদি দেশে ফিরে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি, আইন মেনে চলা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলার স্পষ্ট বার্তা দেন, তাহলে তা একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এটি শুধু বিএনপির জন্য নয়, সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক হবে।
এই প্রত্যাবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নির্বাচন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে নির্বাচন দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কের বিষয়। ভোটার অংশগ্রহণ, প্রশাসনিক ভূমিকা এবং ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারেক রহমান দেশে ফিরলে বিএনপি নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হবে, তবে এখানেই একটি ইতিবাচক সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তিনি নির্বাচন সংস্কারকে কেবল আন্দোলনের স্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে নীতিনির্ভর ও তথ্যভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে নেন, তাহলে তা নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর গঠনমূলক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দেশ বর্তমানে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ, মূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থানের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সংকটকে আরও গভীর করতে পারে, আবার দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সহায়কও হতে পারে। তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনমুখী অর্থনীতি, বেসরকারি খাতের বিকাশ এবং কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন। তাঁর প্রত্যাবর্তন যদি এই অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সুস্পষ্ট নীতিতে রূপ দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে, তাহলে বিএনপি একটি বাস্তবসম্মত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারে।
তরুণ সমাজের প্রসঙ্গ এই আলোচনায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভোটার কাঠামোতে তরুণদের সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। এই প্রজন্ম রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শুধু ক্ষমতার ভাষা নয়, বরং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার স্পষ্টতা দেখতে চায়। তারেক রহমানের একটি ইতিবাচক দিক হলো, তিনি তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। তাঁর প্রত্যাবর্তন যদি দলীয় কাঠামোর ভেতরে বাস্তব প্রজন্মগত পরিবর্তনের সূচনা করে, তাহলে তা বিএনপির দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন গুরুত্ব বহন করে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি কৌশলগত দেশ এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর নজর এখানে সক্রিয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ নতুন নয়। তারেক রহমান দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক পরিসরে অবস্থান করার ফলে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক কাঠামো, কূটনৈতিক আচরণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এই অভিজ্ঞতা যদি দেশের রাজনীতিতে বাস্তববাদী ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির রূপ নেয়, তাহলে তা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে।
এই প্রথম পর্বে একটি বিষয় স্পষ্ট-তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কোনো একক ফলাফলের নিশ্চয়তা দেয় না, তবে এটি একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। এই সুযোগ গণতান্ত্রিক ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকা পুনরুদ্ধারের দিকে এগোতে পারে। এই সম্ভাবনা কতটা বাস্তবে রূপ নেবে, তা নির্ভর করবে পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আচরণ এবং কৌশলের ওপর।
এই ধারাবাহিক বিশ্লেষণের পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর বিএনপির সাংগঠনিক রূপান্তর, নির্বাচন কৌশল এবং ৩১ দফা কর্মসূচি বাস্তব রাজনীতিতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। (প্রথম পর্ব)। চলবে-
লেখক: মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
