বিশ্লেষণ: তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন, নীতি, শাসন ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন (তৃতীয় পর্ব)

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান
শেয়ার করুন

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন যদি কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতির বড় সংকটটি এখন ক্ষমতার বাইরে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার ভেতরে। রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো, নীতিনির্ধারণের স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং নাগরিক অধিকার-এই বিষয়গুলোই ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রকৃত পরীক্ষাক্ষেত্র। এই জায়গায় তারেক রহমানের ইতিবাচক ভূমিকা মূল্যায়ন করা জরুরি, কারণ তাঁর নেতৃত্বের দাবি এখন শুধু সরকার পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার বিকল্প দর্শন উপস্থাপনের সঙ্গে যুক্ত।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে শাসনব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা হলো ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ। নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর বিস্তৃত হয়েছে-এমন অভিযোগ নতুন নয়। এই বাস্তবতায় তারেক রহমানের ঘোষিত রাজনৈতিক দর্শনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার যে বক্তব্য উঠে আসে, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক পেশাদারত্ব এবং স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করার কথা বলেছেন। দেশে ফিরে এই অবস্থান যদি নীতিগত প্রস্তাবে রূপ নেয়, তাহলে তা শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের সূচনা করতে পারে।

এখানেই বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির গুরুত্ব প্রকট হয়। এই কর্মসূচি কেবল একটি নির্বাচনী ইশতেহার নয়; এটি মূলত রাষ্ট্র পুনর্গঠনের একটি রূপরেখা। এতে প্রশাসনিক জবাবদিহিতা, দুর্নীতি দমন এবং নাগরিক অধিকার সুরক্ষার যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছাই সবচেয়ে বড় বিষয়। তারেক রহমানের ইতিবাচক দিক হলো, তিনি এই কর্মসূচিকে দলীয় প্রচারণার বাইরে এনে জাতীয় আলোচনার অংশ করতে আগ্রহী। যদি তিনি দেশে ফিরে এই ৩১ দফার প্রতিটি বিষয়ে বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের পথ তুলে ধরেন, তাহলে তা রাজনীতিকে স্লোগাননির্ভরতা থেকে নীতিনির্ভরতায় নিয়ে যেতে পারে।

অর্থনৈতিক শাসনের প্রশ্নে তারেক রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ বর্তমানে এমন একটি অর্থনৈতিক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, প্রবৃদ্ধির গুণগত মানই বড় প্রশ্ন। বৈষম্য বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের চাপ, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এবং উৎপাদন খাতে স্থবিরতা-এসব সমস্যার সমাধান কেবল বাজেট বা প্রকল্প দিয়ে সম্ভব নয়; প্রয়োজন একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক দর্শন। তারেক রহমানের রাজনৈতিক বক্তব্যে উৎপাদনমুখী অর্থনীতি, বেসরকারি খাতের ভূমিকা এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টির ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা এই জায়গায় ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বিশেষ করে কর্মসংস্থান সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সামাজিক চ্যালেঞ্জ। প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে তারেক রহমান যদি দক্ষতা উন্নয়ন, কারিগরি শিক্ষা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা খাতকে রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রে আনেন, তাহলে তা সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার চেয়েও রাষ্ট্রীয় স্থায়িত্বের প্রশ্ন।

সামাজিক কাঠামোর ক্ষেত্রেও একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে বিভাজনমূলক ভাষা ও সংস্কৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। রাজনৈতিক মতভিন্নতা প্রায়ই শত্রুতায় রূপ নিয়েছে, যার প্রভাব সমাজেও পড়েছে। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ভাষ্যে জাতীয় ঐক্য, ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং প্রতিহিংসাহীন রাজনীতির যে বার্তা পাওয়া যায়, তা সামাজিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থান যদি কেবল বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক আচরণে প্রতিফলিত হয়, তাহলে তা সমাজে আস্থার সংকট কাটাতে সহায়ক হতে পারে।

মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নেও তারেক রহমানের ভূমিকা ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা যায়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ-এসব বিষয় আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে যুক্ত। তারেক রহমান দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক পরিবেশে অবস্থান করার ফলে এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন। দেশে ফিরে তিনি যদি মানবাধিকার প্রশ্নে একটি সুস্পষ্ট ও ধারাবাহিক অবস্থান নেন, তাহলে তা রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক পুনর্গঠনে সহায়ক হতে পারে।

এই পর্বে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের গভীরে রয়েছে এই বিশ্বাসের ঘাটতি। মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নিজের পক্ষে মনে করে না, আবার রাজনীতিকদের প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থাও দুর্বল। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন যদি এই বিশ্বাস পুনর্গঠনের একটি প্রক্রিয়া শুরু করে-যেখানে নীতি, আচরণ ও সিদ্ধান্তের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে-তাহলে সেটিই হবে তাঁর সবচেয়ে বড় ইতিবাচক অবদান।

এই ধারাবাহিক বিশ্লেষণের তৃতীয় পর্বে মূলত স্পষ্ট হয় যে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে শাসনব্যস্থা, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে তাঁর প্রস্তাবিত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এটি কোনো তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের প্রশ্ন নয়, বরং রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের প্রশ্ন।

পরবর্তী ও শেষ পর্বে আলোচনা করা হবে, এই প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ, আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর কী ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।

লেখক: মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।


শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত