তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন: গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব (শেষ পর্ব)
তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় একটি মৌলিক প্রশ্নে-এই প্রত্যাবর্তন কি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থিতিশীল করবে, নাকি এটি কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পুরোনো চক্রকেই নতুন করে সক্রিয় করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু পরিবর্তনের মুহূর্ত এসেছে, কিন্তু সেগুলোর অনেকগুলোই দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারে রূপ নিতে পারেনি। এই বাস্তবতায় তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে একটি সম্ভাবনার জানালা হিসেবে দেখা যায়, যার ফল নির্ভর করবে রাজনৈতিক আচরণ ও সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতার ওপর।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিকতা। সরকার পরিবর্তন হলেও যদি শাসনব্যবস্থার চরিত্র অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের ইতিবাচক দিক হলো, তিনি গণতন্ত্রকে কেবল ভোটের দিন নয়, বরং একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নাগরিক অধিকার এবং রাজনৈতিক সহনশীলতার ওপর যে গুরুত্ব দেখা যায়, তা গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে এই প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য আরও গভীর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি অস্থির চক্র কাজ করেছে-আন্দোলন, দমন, পাল্টা আন্দোলন এবং পুনরায় সংঘাত। এই চক্র ভাঙতে হলে প্রয়োজন দায়িত্বশীল বিরোধী রাজনীতি ও সহনশীল ক্ষমতার চর্চা। তারেক রহমান যদি দেশে ফিরে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে শত্রুতায় পরিণত না করে নীতিগত বিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন, তাহলে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এটি শুধু বিএনপির জন্য নয়, সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করবে।
দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনীতির সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তা টেকসই হতে পারে তখনই, যখন রাজনৈতিক পরিবেশ পূর্বানুমেয় ও সহনশীল হয়। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিবর্তে একটি নীতিনির্ভর প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে, তাহলে সেটি অর্থনৈতিক আস্থার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই আস্থা কেবল দেশীয় বিনিয়োগ নয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থান আগামী দিনে আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, আঞ্চলিক ভারসাম্য এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন-এই বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তারেক রহমানের দীর্ঘ আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এই জায়গায় একটি ইতিবাচক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি যদি দেশে ফিরে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, বাস্তববাদী এবং বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতির ধারণা সামনে আনেন, তাহলে তা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও স্থায়িত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন যদি একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখে, তাহলে তা আন্তর্জাতিক চাপ কমাতে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও কার্যকর করতে পারে। এই দিকটি ভবিষ্যৎ সরকারের জন্যও একটি ইতিবাচক ভিত্তি তৈরি করবে।
দীর্ঘমেয়াদে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতির পরিবর্তন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রজন্মান্তরে সরে এলেও রাজনৈতিক আচরণে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন খুব একটা দেখা যায়নি। তারেক রহমানের সামনে একটি সুযোগ রয়েছে—তিনি চাইলে নিজেকে শুধু একটি রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে নয়, বরং একটি রূপান্তরকামী নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। এই রূপান্তর নির্ভর করবে তাঁর সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা, সহনশীলতা এবং নীতির সঙ্গে আপসহীন থাকার সক্ষমতার ওপর।
সবশেষে বলা যায়, তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সম্ভাবনার অধ্যায় খুলে দিয়েছে। এই অধ্যায় কীভাবে লেখা হবে, তা এখনো নির্ধারিত নয়। এটি হতে পারে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি সূচনা, আবার হতে পারে পুরোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নতুন সংস্করণ। তবে তাঁর ইতিবাচক দিক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং নীতিনির্ভর বক্তব্য যদি বাস্তব আচরণে প্রতিফলিত হয়, তাহলে এই প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই ধারাবাহিক বিশ্লেষণের উপসংহার হিসেবে বলা যায়, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নিজে কোনো সমাধান নয়, কিন্তু এটি একটি সুযোগ। এই সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সদিচ্ছা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের ওপর। ইতিহাস শেষ পর্যন্ত এই প্রত্যাবর্তনকে মূল্যায়ন করবে তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়, তার পরিণতি দিয়ে।
লেখক: মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।
