স্মৃতি, উত্তরাধিকার ও প্রত্যাবর্তন: জাইমা রহমানের ভাষ্য ও রাজনৈতিক পাঠ
কিছু লেখা কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ নয়; সেগুলো সময়, ইতিহাস ও রাজনীতির সঙ্গে সংলাপে বসে যায়। জাইমা রহমানের সাম্প্রতিক আবেগঘন স্ট্যাটাসটি তেমনই একটি বয়ান-যেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি, পারিবারিক উত্তরাধিকার, প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখাটি পড়তে গেলে স্পষ্ট হয়, এটি কোনো তাৎক্ষণিক আবেগের বিস্ফোরণ নয়; বরং দীর্ঘ সময় ধরে জমে ওঠা আত্মপরিচয়ের একটি সচেতন ঘোষণা।
লেখাটির কেন্দ্রে রয়েছে ‘দাদু’-একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং একই সঙ্গে একজন মমতাময়ী পারিবারিক অভিভাবক। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভার আর পারিবারিক স্নেহের দ্বৈততা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মানবিক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি লাখো মানুষের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতীক, তিনি নাতনির চোখে একজন মনোযোগী শ্রোতা, গর্বিত অভিভাবক। এগারো বছরের একটি শিশুর ফুটবল মেডেল দেখার মুহূর্তকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রায়শই উপেক্ষিত গুণের দিকে ইঙ্গিত করে-মন দিয়ে শোনা। আধুনিক নেতৃত্ববিষয়ক গবেষণায় (servant leadership ও empathetic leadership) এই গুণটিকেই টেকসই নেতৃত্বের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই স্মৃতিচারণ নিছক নস্টালজিয়া নয়। এটি রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের একটি মানবিক পুনঃসংজ্ঞা। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বা “political dynasty” নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে, সেখানে সাধারণত ক্ষমতা হস্তান্তরের দিকটিই আলোচিত হয়। কিন্তু জাইমার লেখায় উত্তরাধিকার মানে ক্ষমতা নয়, বরং মূল্যবোধ-নম্রতা, দায়িত্ববোধ এবং মানুষের কথা শোনার মানসিকতা। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গণতান্ত্রিক সমাজে নেতৃত্বের বৈধতা কেবল নাম বা বংশ থেকে আসে না; আসে আচরণ ও নৈতিক অবস্থান থেকে।
স্ট্যাটাসটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো প্রবাসী পরিচয়ের বিশ্লেষণ। সতেরো বছর দেশের বাইরে কাটানোর অভিজ্ঞতা তাঁকে “বাস্তববাদী” এবং “বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন” করেছে-এটি কোনো আলঙ্কারিক বাক্য নয়। গবেষণায় দেখা যায়, দীর্ঘমেয়াদি প্রবাসজীবন ব্যক্তির মধ্যে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি (comparative perspective) তৈরি করে, যা রাষ্ট্র, আইন ও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে আরও সূক্ষ্ম উপলব্ধি দেয়। জাইমার আইন পেশায় কাজ করার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় সেই বৈশ্বিক নাগরিকত্বের চর্চা স্পষ্ট-ন্যায়বিচারকে তিনি তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বাস্তব দায়িত্ব হিসেবে দেখেন।
এখানে লক্ষণীয়, তিনি নিজেকে ‘নেত্রী’ বা ‘রাজনৈতিক কর্মী’ হিসেবে ঘোষণা করেননি। বরং নিজেকে স্থাপন করেছেন একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে, যিনি শুনতে চান, বুঝতে চান এবং সরাসরি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চান। এটি সমসাময়িক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে রাজনীতি ক্রমশই এলিট-নির্ভর ও দূরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাঠপর্যায়ের মানুষের সঙ্গে সংযোগের ঘাটতি রাজনৈতিক অনাস্থা বাড়িয়েছে-যা বিভিন্ন জনমত জরিপ ও গবেষণায় উঠে এসেছে।
‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান’ ও ৫ আগস্টের আগে-পরে নেপথ্যে ভূমিকা রাখার প্রসঙ্গটি লেখাটিকে আরও রাজনৈতিক তাৎপর্য দেয়। এখানে তিনি উচ্চকণ্ঠে নিজের ভূমিকা জাহির করেননি; বরং “কম বলা, বেশি শোনা”-র নীতি তুলে ধরেছেন। এটি একদিকে রাজনৈতিক পরিপক্বতার ইঙ্গিত, অন্যদিকে সংকটকালীন রাজনীতিতে দায়িত্বশীল আচরণের একটি নরম কিন্তু দৃঢ় দাবি।
সবশেষে, দেশে ফেরার ঘোষণা কেবল ভৌগোলিক প্রত্যাবর্তন নয়; এটি নৈতিক ও মানসিক প্রত্যাবর্তন। ‘দাদু’র পাশে থাকা, ‘আব্বু’কে সহায়তা করা এবং দেশের জন্য সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার আকাঙ্ক্ষা-এই তিনটি স্তর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতাকে এক বিন্দুতে মিলিত করে। তিনি জনগণের কৌতূহল ও প্রত্যাশার কথাও স্বীকার করেছেন, যা রাজনীতিতে বিরল এক ধরনের স্বচ্ছতা। প্রত্যাশার চাপ অস্বীকার না করে তা বহনের মানসিক প্রস্তুতির কথাই এখানে বলা হয়েছে।
জাইমা রহমানের এই লেখা তাই কোনো প্রচারমূলক বক্তব্য নয়; এটি এক ধরনের নৈতিক অবস্থান গ্রহণ। স্মৃতি থেকে নেতৃত্ব, প্রবাস থেকে প্রত্যাবর্তন, পরিবার থেকে রাষ্ট্র-এই ধারাবাহিকতায় লেখাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের গল্প দিয়েই গঠিত। আর সেই গল্পগুলো যদি সততা ও শ্রবণের মানসিকতায় বলা হয়, তবে হয়তো “একসঙ্গে বাকি পথটা হাঁটার” সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
রেফারেন্স ও প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র: Max Weber, Politics as a Vocation -নেতৃত্ব ও নৈতিক দায়বদ্ধতার ধারণা
Robert K. Greenleaf, Servant Leadership – নেতৃত্বে নম্রতা ও শোনার গুরুত্ব,UNDP, Human Development Report (প্রবাসী পরিচয় ও বৈশ্বিক নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ), বিশ্বব্যাংক ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউটের গবেষণা – দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক আস্থা ও নাগরিক অংশগ্রহণ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র বিষয়ে একাডেমিক গবেষণা (উদাহরণ: Christophe Jaffrelot) বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও নাগরিক সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ ও কলামসমূহ
লেখক : হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।
