৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি।পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের অন্যায়,অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিলতিল করে স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন,‘৬৬-এর ছয়দফা,’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান তারপর ৭০-এর নির্বাচনে বিজয় লাভ।স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেন।তিনি জানতেন কখন কোথায় কোন বক্তব্য দিতে হবে।তিনি সারা জীবন যা বিশ্বাস করতেন,সেই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই ৭ মার্চের ভাষণ দেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলার জনগণ ৬ দফার পক্ষে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়।একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।কিন্তু পাকিস্তানি শাসক চক্র ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা ধরনের টালবাহানা শুরু করে।৩ রা মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে পূর্বপাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে।সেসময় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক চলছিল।তখনই রেড়িওতে ঘোষিত হয় প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করেছে।ইয়াহিয়ার ঘোষণার পর ঢাকা সহ সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।প্রতিবাদে দলমত নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় নেমে আসে।লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে পুরো ঢাকা শহর।প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায়, ৩ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেন।তিনি আরো ঘোষণা করেন,৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তিনি বাঙালি জাতির করণীয় কি সেটা জানাবেন।
৭ মার্চের ভাষণ বানচাল করতে পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠী অনেক চেষ্টা করেছে।প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার Witness to Surrender’গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠী কূটকৌশলের আশ্রয় নিল।৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা,আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে।জেনারেল ইয়াহিয়া ৬ মার্চ তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন,‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিন্ধান্ত গ্রহণ না করেন,যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি জাতিকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। ভাষণে তিনি প্রথমে অতীত ইতিহাস, মাঝের দিকে,অন্যায়,অত্যাচার ও অবিচারের কথা তুলে ধরেন এবং শেষাংশে জনগণের করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন।‘ভাষণে পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্যে চারটি শর্ত দিয়েছেন-(১)মার্শাল ল প্রত্যাহার,(২)সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া,(৩)রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং(৪) জন প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এসব দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দাবি পূরণের পর ভেবে দেখবো অ্যাসেম্বলিতে বসব কিনা?একদিকে তিনি আলোচনার পথ খোলা রেখেছেন,অন্যদিকে চুড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।আবার তিনি কৌশলে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেন,‘পাড়া মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করো,যা যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত হও,ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো।’এবং শেষাংশে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে বক্তব্য শেষ করেন।
মুক্তিপাগল বাঙালিদের দমন করতে ভাষণের ১৮ দিন পর অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের উপর গণহত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।সঙ্গে সঙ্গেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার চুড়ান্ত ঘোষণা দেন।এবং বলেন,‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা,আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই,আপনারা যেখানে থাকুন,আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান।বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।মুক্তি পাগল বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গ্রহণ করে শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে মাত্র নয় মাসেই বিজয় লাভ করে।পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি,সে ব্যাখ্যা ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিট্রিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ঘটনা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,‘আমি জানতাম এর পরিনতি কি হবে,এজন্যই আমি ঘোষণা করি এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।ডেভিড ফ্রস্ট আরো প্রশ্ন করেন,’আপনি যদি বলতেন,আজ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি,তাতে কী ঘটত?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশেষ করে আমি সেদিন এটি চাইনি।কেননা,বিশ্বকে তাদের এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে তাকে আঘাত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিলনা।আমি চাইছিলাম তারাই প্রথম আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।’ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,বঙ্গবন্ধুর সিন্ধান্ত শতভাগ সঠিক ছিল।তিনি একসাথে দুটো কাজ করেছেন।একদিকে তিনি জনগণকে স্বাধীনতার বার্তা দিয়েছেন,অন্যদিকে পাকিস্তানকে প্রথম আঘাত করতে প্রলুব্ধ করেছ।
১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি চালানো একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল।স্বাধীনতা বিরোধীদের ছত্রছায়ায় পরিচালিত তৎকালীন সরকার গুলো ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ছোট করতে একজন পাঠককে ঘোষক বানানোর নিরন্তর চেষ্টা চালানো হয়।কিন্তু ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর।সত্য একদিন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়।আজ দেশের পবিত্র সংবিধানেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।২০১৩ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তক গুলোতেও বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বেও এই ভাষণ সমানভাবে সমাদৃত।২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ ‘ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।ব্রিটেনের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিতের ৪১ টি ভাষণ নিয়ে ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’-দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি(we shall fight on beaches:the speeches that inspired history)শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।
৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার মূলমন্ত্র।এ ভাষণে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি শুধু ঐক্যবদ্ধই করেনি,মাত্র আঠার দিনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।কার্যত এই ভাষণই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।এই ভাষণের সার্বজনীনতা চিরকাল বিশ্বব্যাপী প্রাসঙ্গিক থাকবে।যখনই মানব মুক্তির প্রসঙ্গ আসবে তখনই এই ভাষণ মুক্তিকামী মানুষদের প্রেরণা জোগাবে।
লেখক:সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ইমেইল:haldertapas80@gmail