আজ পারমাণবিক ক্লাবে ঢুকছে বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

রূপপুরে নির্মীয়মাণ দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক ক্লাবের সদস্যও হতে যাচ্ছে দেশটি।

দুই ইউনিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের সামগ্রিক কাজের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হওয়ায় সম্প্রতি রাশিয়া থেকে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান রূপপুরকঠোর নিরাপত্তায় প্রকল্পে আনা হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প এলাকায় বাংলাদেশের কাছে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করবেন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি করপোরেশনের (রোসাটম) মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ।

অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসিও ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন। এর মধ্যে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর প্রক্রিয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আরেকটি ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

অনুষ্ঠানটি ঘিরে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে পুরো প্রকল্প এলাকা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) ২ শতাংশ অবদান রাখবে। সঞ্চালন লাইনসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি হওয়ার পরই পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হবে। ২০২৫ সালের শুরুতে প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।

উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগণ এই প্রকল্প থেকে উপকৃত হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। ইউরেনিয়াম প্রকল্প এলাকায় আসার পরই এটি পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩৩তম সদস্য হতে যাচ্ছে।’

ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১২ থেকে ১৫ বছর সময় লেগেছে।

সে হিসেবে মাত্র সাত থেকে আট বছরের মধ্যে নিউক্লিয়ার প্লান্ট নির্মাণ করা একটা মাইলফলক। এ সবই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।’ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরুর পর সব ধরনের কার্যক্রম দেশের প্রকৌশলীরাই পরিচালনা করবেন বলেও মন্ত্রী জানান।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. শৌকত আকবর বলেন, ‘আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট। প্রথমে ইউনিটটির উৎপাদন সক্ষমতার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ এবং পরে ৫০ শতাংশে যাবে। এভাবে কয়েক ধাপে টানা প্রায় ১০ মাসে শতভাগ পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাবে কেন্দ্রটি। তবে এই ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে।’

প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের সামগ্রিক কাজ ৯০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে।’

তবে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ যেভাবে এগিয়েছে, সঞ্চালন লাইনের কাজ সেভাবে এগোয়নি। এ বিষয়ে শৌকত আকবর বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রিড লাইন ও সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ এগোতে পারেনি। তবে এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টি তদারকি করা হচ্ছে। আশা করছি, গ্রিড লাইন সময়মতো হবে। গ্রিড লাইন নির্মাণ সম্পূর্ণ না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যাবে না।’ সরকারের পরিকল্পনায় রূপপুরে আরো দুই ইউনিটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার লক্ষ্য রয়েছে বলেও প্রকল্প পরিচালক জানান।

দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্পটি দেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার। মোট ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিভিইএল ফুয়েল কম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের থেকে পারমাণবিক জ্বালানি কেনে।

ইউরেনিয়াম সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব

তেজস্ক্রিয় জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়ামের ঝুঁকি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তি ও নির্মাণ কৌশলের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়ামের ব্যবহার দিন দিন নিরাপদ হয়ে উঠছে।

এ ছাড়া ইউরেনিয়াম আর্থিক দিক দিয়ে এলএনজি, কয়লা ও জ্বালানি তেলের চেয়ে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে ইউরেনিয়ামের জ্বলন শক্তি বেশি। এক কেজি ইউরেনিয়ামের জ্বালানি সক্ষমতা ৬০ টন ডিজেল ও ১০০ টন কয়লার সমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কার্বন সালফার নির্গমনের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে। এ জন্যই পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব।’

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৬১ সালে। এরপর নানা সময় প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কিছু কাজ হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরে দেশটির সঙ্গে রূপপুর প্রকল্পের ঋণ চুক্তি সই হয়। একই বছর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন (প্রথম পর্যায়) প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


শেয়ার করুন

Similar Posts