গণভোট পেছনে ফেলে, বিএনপির মনোনয়ন নতুন এক রাজনৈতিক কৌশল
বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক দৃশ্যপট এক জটিল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে যে “গণভোট” ও “প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR)” পদ্ধতির দাবি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, সেই আলোচনাকে পিছনে ফেলে এখন সামনে এসেছে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের নাটকীয় সিদ্ধান্ত। এই পরিবর্তন নিছক কৌশলগত পদক্ষেপ নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার এক যুগান্তকারীর ইঙ্গিতবাহী।
বিএনপি বহুদিন ধরেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে এসেছে। তাদের অবস্থান ছিল পরিষ্কার-তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। এই অবস্থানের কারণেই তারা গত এক যুগের বেশি সময় ধরে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকেছে, রাজনৈতিক মাঠে আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সময়ের প্রেক্ষাপটে ও বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির নেতৃত্ব এখন এক নতুন পথে হাঁটছে, যেখানে আন্দোলনের পরিবর্তে অংশগ্রহণের কৌশলকে সামনে রাখা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি গণভোটের ধারণারও তীব্র বিরোধিতা করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে গণভোট সংবিধানসম্মত নয় বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে। এই অবস্থান দলের নীতিগত দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ হলেও, রাজনীতির বাস্তবতার কঠিন পর্বে এসে বিএনপি বুঝেছে-রাজপথের আন্দোলন দলীয় কর্মীরা একা যথেষ্ট নয়; জনমতের পরীক্ষায় নিজেদের জনগনের সমাগমে উপস্থিতি না রাখলে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংলাপ, কূটনৈতিক পরামর্শ ও অভ্যন্তরীণ চাপে বিএনপির অবস্থানে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা যেভাবে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন, সেটি বিএনপির ওপর পরোক্ষ চাপ হিসেবে কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বারবার প্রশ্ন উঠেছে-বিকল্প শক্তি যদি নির্বাচনেই না আসে, তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা পাবে? এই বাস্তবতা বিএনপিকে নির্বাচনে কৌশলগত অংশগ্রহণের পথে প্রার্থী মনোনয়নের পথ দেখিয়েছে।
সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই সম্প্রতি বিএনপি তাদের প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। দলটি শুধু কেন্দ্রীয় নির্দেশনা নয়, বরং স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক অবস্থান, প্রভাব ও জনসম্পৃক্ততা যাচাই করে প্রার্থী বাছাই করেছে। অনেক জায়গায় তারা জোট ও সহযোগী দলগুলোর জন্য আসন ছেড়ে রেখেছে-যা নির্দেশ করে যে বিএনপি একক লড়াই নয়, বরং সমন্বিত শক্তির প্রদর্শন করতে চায়।
এই মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে ঘিরে সৃষ্ট নাটকীয়তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন আলোরণ সৃষ্টি করেছে। বহু বছর পর বিএনপির কার্যালয়ে জমে উঠেছে প্রার্থীদের ভিড়, নেতাকর্মীদের মধ্যে ফিরে এসেছে নির্বাচনী উচ্ছ্বাস। দলটি বুঝতে পারছে-জনসম্পৃক্ততা বজায় রাখার জন্য মাঠে সক্রিয় থাকা জরুরি, কারণ রাজনীতিতে শূন্যস্থান কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
এই পরিবর্তন বিএনপির কৌশলগত অভিযোজনের ইঙ্গিত দেয়-যেখানে দলটি জানে, নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ধরে রাখার বিকল্প নেই। আন্দোলনের হতাশা কাটিয়ে দলীয় কর্মীদের পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মনোনয়ন প্রক্রিয়া এখন কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
তবে, এই কৌশল বাস্তবায়নের পথ মসৃণ নয়। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিএনপির জন্য এটি এক ধরনের ভয়াল ট্রমা-গত কয়েকটি নির্বাচনে তারা যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, তা এখনো দলের স্মৃতিতে তাজা। এবারের নির্বাচনে তারা কতটা পেশাদারিত্ব ও সংগঠনগত দক্ষতা বজায় রাখতে পারে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
অর্থনীতি ও সমাজের দিক থেকেও এই নির্বাচন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দীর্ঘ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) থেকে শুরু করে দেশীয় বিশ্লেষকরা বলছেন-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফিরলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব। তাই এই নির্বাচন কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং অর্থনীতি ও সামাজিক আস্থার পুনর্গঠনেরও এক পরীক্ষা।
বৈশ্বিক পর্যবেক্ষকরা এই নির্বাচনে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির প্রভাব, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার রিপোর্ট, জাতিসংঘের অবস্থান-সবই এই নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে প্রভাবিত করবে। বিএনপির নির্বাচনী অংশগ্রহণ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নতুন করে ভাবার সুযোগ দেবে, যদি প্রক্রিয়াটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক হয়।
অতএব, গণভোট ও পিআর দাবির পেছনে পড়ে থাকা এই প্রেক্ষাপট আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিযাত্রার নতুন অধ্যায়। বিএনপি যদি মাঠে থাকে, প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, তাহলে নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে একধরনের আস্থা ফিরে আসতে পারে। আর এই আস্থাই আগামী দিনের রাজনীতির মূল ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।
শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন প্রমাণ করবে-বাংলাদেশ কি “সংকটের রাজনীতি” থেকে বেরিয়ে “প্রতিযোগিতার রাজনীতি”-তে প্রবেশ করছে, নাকি আগের মতোই একমুখী কাঠামোয় ফিরে যাচ্ছে। বিএনপির এই কৌশল পরিবর্তন তাই শুধু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নয়, বরং এক রাজনৈতিক যুগান্তরের সূচনা।
লেখক: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।
