জাতীয় নির্বাচন: নিরাপত্তাবিঘ্নসহ বহুমাত্রিক ঘটনায় দেশের রাজনীতিতে গভীর সংকট!
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এক জটিল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহে অগ্রসর হচ্ছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি, নিরাপত্তা, প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টি মিলিয়ে একটি বহুমাত্রিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সংবেদনশীল অবস্থা তৈরি করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ের পাঁচটি বিষয়-বিএনপির ২৩৭ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন ও নির্বাচনী মাঠে সক্রিয়তা, সেনাবাহিনীর আংশিক প্রত্যাহার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের ১০ থেকে ১৩ তারিখ মাঠে নামার ঘোষণা, জামায়াত নেতার ‘সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে বাঁকা করতে হবে’ মন্তব্য, এবং চট্টগ্রামে বিএনপি নেতার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা-এগুলো একত্রে বাংলাদেশের রাজনীতির গভীর সংকটকে স্পষ্ট করে তুলেছে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা আছে, যা কেবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং জাতির সামগ্রিক মনস্তত্ত্ব ও গণতান্ত্রিক পরিণতির প্রতিফলন।
বর্তমান পরিস্থিতির সূচনা মূলত বিএনপির নির্বাচনী সক্রিয়তা থেকেই। বহুদিনের আন্দোলন, গ্রেফতার, বিক্ষোভ ও অনিশ্চয়তার পর দলটি যখন ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে, তখন সেটি শুধু রাজনৈতিক ঘোষণা নয় এটি একপ্রকার মানসিক যুদ্ধের অংশ। এই পদক্ষেপে দলের ভেতরে নতুন প্রাণসঞ্চার ঘটে, দীর্ঘদিন ধরে নিস্তেজ কর্মীরা আবার মাঠে নেমে আসে, নির্বাচনী গ্রাম ও মহল্লায় আবার রাজনৈতিক আলাপ শুরু হয়। ফলে দেশে একটি নির্বাচনী আবহ সৃষ্টি হয়-যা ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত সবাইকে নির্বাচনের চিন্তার পরিসরে টেনে আনে। পাশাপাশি একটি অনিবার্য বাস্তবতা সামনে আসে যখন একটি বড় দল মাঠে নামে, তখন ছোট দলগুলোর জায়গা সংকুচিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য কিছুটা ম্রিয়মান হতে শুরু করে, কারণ ভোটের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসে দুই প্রধান শক্তি-আওয়ামী লীগ ( স্থগিত) ও বিএনপি।
বিএনপির মাঠে নামার সাথে সাথে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক বাস্তবতা নতুনভাবে আলোচনায় আসে। নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্যায়ে সেনাবাহিনী “প্রশিক্ষণ” বা “নিয়মিত কার্যক্রম”-এর কারণে তাদের একটি বড় অংশ ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নেয়, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন প্রশ্ন তোলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী সাধারণত স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তাদের উপস্থিতি অনেক সময়ই ভোটারদের নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার অনুভূতি জাগায়। তাই, যখন এই বাহিনী আংশিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়, তখন জনগণের মনে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়-নির্বাচনী সহিংসতা বা প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব কি বেড়ে যাবে? রাজনৈতিক দিক থেকে এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক টার্নিং পয়েন্ট, কারণ মাঠে থাকা কর্মীরা সাহসী হলেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে তারা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে।
এই উদ্বেগের মধ্যেই আওয়ামী লীগও মাঠে নামার ঘোষণা দেয় ১০ থেকে ১৩ তারিখের কর্মসূচি। এই ঘোষণা হয়তো তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে, কিন্তু বাস্তবে এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। বিএনপির নির্বাচনী উত্তেজনা ও মাঠে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার বিপরীতে আওয়ামী লীগ দেখাতে চায় তারা এখনও সংগঠিত, তারা এখনও ফুরিয়ে বা হারিয়ে যায়নি।
জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে এই ঘোষণা দলীয় মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি একটি বার্তা দেয় যে, আওয়ামী লীগও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিজেদের অবস্থানে যেতে চায়। এটি ক্ষমতাসীন সরকারের দৃষ্টিতে উদ্বেগের কারণ নির্বাচনী মাঠে প্রতিপক্ষের দৃশ্যমান উপস্থিতি জনগণের মধ্যে “ক্ষমতার পরিবর্তন হতে পারে”-এর ধারণা জাগাতে পারে, যা সরকার-পক্ষের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে আজ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এর করা মন্তব্যে-“সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে” এটা রাজনীতির মনস্তাত্ত্বিক উত্তাপকে আরও বাড়িয়ে দিলো। এই বক্তব্য নিছক হুমকি নয়, এটি মূলত বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতি একপ্রকার হতাশা ও প্রতিরোধের ইঙ্গিত। এতে বোঝা যায়, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে বিকল্প পন্থায় চাপ প্রয়োগের সম্ভাবনা বাড়ছে। গণভোট বা বিকল্প প্রস্তাবের মতো ভাবনা সেই হতাশারই বহিঃপ্রকাশ। এই অবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা-উভয়ই এক অনিশ্চিত ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে যায়। কারণ যদি মূলধারার দলগুলো অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিতে আস্থা হারায়, তবে চরমপন্থা, সহিংসতা বা অরাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবণতা বাড়তে পারে।
এহেন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের নির্বাচনী সভায় বিএনপি প্রার্থীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এই আশঙ্কার বাস্তব রূপ। একটি প্রচারণায় গুলিবর্ষণ শুধু নিরাপত্তা ব্যর্থতা নয়, এটি নির্বাচনী সহিংসতার সাংকেতিক সূচনা। এই ধরনের ঘটনা ভোটারদের মনে ভয় তৈরি করে-তারা প্রশ্ন করতে শুরু করে, “এই ভোটে অংশ নেওয়া কি নিরাপদ?” রাজনৈতিক সহিংসতা যত বাড়ে, অংশগ্রহণ তত কমে, এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচন “অংশগ্রহণমূলক” না হয়ে “প্রদর্শনমূলক” হয়ে পড়ে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চট্টগ্রামের ঘটনাটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং সামগ্রিক নির্বাচনী মনস্তত্ত্বের উপর প্রভাব বিস্তারকারী বার্তা।
ধারাবাহিক এই ঘটনাপ্রবাহে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জনগণের সম্পর্ক নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। একদিকে বড় দলগুলো নিজেদের টিকে থাকা ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, অন্যদিকে জনগণ চাইছে একটি শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) নির্বাচন-যেখানে তারা ভয়হীনভাবে ভোট দিতে পারবে। আন্তর্জাতিক মহলও এই দিকেই দৃষ্টি রাখছে, কারণ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। সেনাবাহিনীর ভূমিকা, ইসির নিরপেক্ষতা, ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা-এই চারটি উপাদান এখন একসূত্রে গাঁথা। এর যেকোনো একটি দুর্বল হলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
অতএব, বিএনপির মাঠে নামা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া, জামায়াতের বক্তব্য থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের সহিংসতা-সবকিছু মিলিয়ে একটি স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়: বাংলাদেশ এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে গণতন্ত্রকে প্রক্রিয়াগত নয়, বরং মানসিকভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। সেনাবাহিনীর সঠিক ভারসাম্য, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক দলের সহনশীলতা এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ-এই চারটি শক্তি যদি একত্রে কাজ না করে, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল যেমনই হোক, তা দেশের গণতান্ত্রিক মানসিকতায় স্থায়ী দাগ ফেলে যাবে। যদি এই উপাদানগুলো পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে সমন্বিত হয়, তাহলে এই নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং জাতির গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের এক নতুন অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: হাফিজ আল আসাদ , বিশ্লেষক ও সমাজ ভিক্তিক উন্নয়ন পরামর্শক সাবেক সিনিয়র কনসালটেন্ট, এমডিসি বাংলাদেশ।
ডিরেক্টর, আর্থ ফাউন্ডেশন।
