বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের হাতে কৃষক ও ফ্যামিলি কার্ডের স্যাম্পল
ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার বার্তা নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রতীক ও বার্তার গুরুত্ব কম নয়। সেই বাস্তবতায়, এবারের সংসদ সদস্য পদে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে “কৃষক কার্ড” ও “ফ্যামিলি কার্ড”-এর স্যাম্পল বিতরণ একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এটি কেবল নির্বাচনী প্রচারণার অনুষঙ্গ নয়; বরং দলটির ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা কী হতে পারে-তার একটি আগাম ইঙ্গিত।
এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বিএনপি একদিকে যেমন কৃষক ও সাধারণ পরিবারের প্রতি রাজনৈতিক অগ্রাধিকার স্পষ্ট করছে, অন্যদিকে তেমনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই মাঠপর্যায়ে একটি সম্ভাব্য নীতির ভিত্তি গড়ে তোলার কৌশল নিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই কার্ড ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে জনস্বার্থ কীভাবে সুরক্ষিত হবে এবং কতটা বিস্তৃত জনগোষ্ঠী এর সুফল পেতে পারে?
বিশ্ব অভিজ্ঞতা বলছে, কৃষক ও পরিবারভিত্তিক কার্ড ব্যবস্থা আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের একটি পরীক্ষিত কৌশল। ভারত, নাইজেরিয়া ও আরও কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে এই ধরনের কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি, কৃষিঋণ, বীমা ও সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা সরাসরি সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি’র প্রস্তাবিত কৃষক কার্ড সেই আন্তর্জাতিক মডেলের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ-যেখানে কৃষককে শুধু ভোটব্যাংক নয়, বরং অর্থনীতির একটি স্বীকৃত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নমিনেশনপ্রাপ্ত প্রার্থীদের হাতে স্যাম্পল কার্ড তুলে দেওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য এখানেই-দলটি চাইছে সংসদ সদস্যরাই হোক এই কর্মসূচির মাঠপর্যায়ের প্রধান বাহক। নির্বাচিত হলে তারা নিজ নিজ এলাকায় কৃষক ও পরিবারভিত্তিক তালিকা প্রস্তুত, যাচাই এবং বাস্তবায়নের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারবেন। এটি একটি বিকেন্দ্রীকৃত কিন্তু নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়, যা জনস্বার্থে কার্যকর হতে পারে।
জনস্বার্থের কৌশলগত দিক
প্রথমত, লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হবে। কৃষক কার্ড থাকলে সার, বীজ, প্রণোদনা বা দুর্যোগকালীন সহায়তা প্রকৃত কৃষকের কাছেই পৌঁছানো সহজ হবে। এতে অপচয় ও অনিয়ম কমার সম্ভাবনা বাড়বে—যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে পরিবারকেন্দ্রিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা সম্ভব।
বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পরিবার রয়েছে। ধাপে ধাপে দরিদ্র, কৃষিজীবী ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারকে অগ্রাধিকার দিলে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রায় ১ থেকে দেড় কোটি পরিবার এই সহায়তার আওতায় আসতে পারে। কৌশলগতভাবে এটি একটি বড় সামাজিক ভিত্তি তৈরি করবে, যা রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক জোরদার করতে পারে।
তৃতীয়ত, তথ্যভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ তৈরি হবে। কৃষক ও পরিবারভিত্তিক একটি সমন্বিত ডাটাবেজ থাকলে বাজেট প্রণয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং কৃষি নীতিতে বাস্তব চাহিদার প্রতিফলন ঘটানো সহজ হবে। এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি কার্যকারিতার দিকেও নিয়ে যাবে।
তবে বাস্তবতার জায়গায় সতর্কতা জরুরি। ডিজিটাল অবকাঠামো, তথ্য হালনাগাদ এবং মাঠপর্যায়ে দক্ষ জনবল ছাড়া এই কার্ড ব্যবস্থা সফল হবে না। কৌশলগতভাবে এটি সফল করতে হলে প্রশাসনিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয় অপরিহার্য। অন্যথায়, এটি ভালো ধারণা হয়েও বাস্তব প্রয়োগে আস্থা হারাতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নমিনেশনপ্রাপ্ত সংসদ সদস্যদের হাতে কৃষক ও ফ্যামিলি কার্ডের স্যাম্পল বিতরণ একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক সংকেত। এটি দেখায় যে দলটি উন্নয়ন ও কল্যাণের প্রশ্নে একটি কাঠামোগত পথের কথা ভাবছে। এখন শেষ পর্যন্ত এই কার্ডের রাজনীতি কি বাস্তব নীতিতে রূপ নেবে, নাকি প্রতীকেই সীমাবদ্ধ থাকবে-তার উত্তর দেবে সময় ও বাস্তবায়নের আন্তরিকতা। জনস্বার্থের বিচারে সাফল্যের চাবিকাঠি এখানেই।
মো: হাফিজ আল আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।
